সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার ইতিহাস

সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার ইতিহাস

ফাইল ছবি।

'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে যে তা রক্ষা করা কঠিন' এবং ঘটে কর্পূর না থাকা যে কি টেনশনের তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন সিঙ্গাপুরীয় নেতা লী কুয়ান ইউ। ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট মালয়েশিয়া থেকে এক রকম ব্রেকআপ হয়ে গভীর ডিপ্রেশনে পড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি ঘোষণা করেছিলেন বিশ্ব মিডিয়ায় সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা। এ যেন বিউগলে বেজে ওঠা বিরহের সুর। অপ্রস্তুত আর ভয়ে ভয়ে স্বাধীন হয়েই যেন বেকায়দায় পড়ল সিঙ্গাপুর।

কারণ মাত্র ৭২৮.৬ বর্গ কিলোমিটারে অতি ক্ষুদ্র সিঙ্গাপুর, বিশাল সংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠী, খাওয়া এবং কর্মসংস্থানের যোগান দিতে পুরো হিমশিম খেতে হবে তা অজানা ছিল না লী কুয়ানের।

কি আর করা, তিনি গ্রহণ করলেন কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তিনি বুঝলেন তাদের একমাত্র শক্তিশালী দিক হচ্ছে সমুদ্র যোগাযোগ। সেটাকেই তাদের পুঁজি করে ব্যবসায় নামতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করে দিলেন তাদের সুমদ্রবন্দর। এর মধ্যে লী কুয়ানের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা খাটলেন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। তা থেকেই মাত্র এক প্রজন্মেই দাঁড় করিয়ে ফেললেন তাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য। তারা বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে এমনই শক্তিশালী যে ২০১৯ হতে শুরু হওয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় সামান্যতম আঁচড়ও পড়েনি তাদের গায়ে। অর্থাৎ সিঙ্গাপুর হচ্ছে সিনেমার সেই নায়কের মত, যাকে বখে যাবার ফলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল মালয়েশিয়া থেকে, পরে সে কঠোর পরিশ্রম করে হয়ে গেল স্বপ্নের নায়ক।

এর পিছনে যদি একটু পৃষ্ঠা উল্টাই তবে দেখতে পায় সিঙ্গাপুরিয়ানদের আরেক ইতিহাস। যেখানে মালয় কাহিনী অনুসারে, ১২৯৯ সালেই স্যাং নিলা উতামা আজকের সিঙ্গাপুরকে 'সিঙ্গাপুরা' নামে নামকরণ করেন। এই স্যাং নিলা উতামা তখন শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী প্যালেমবাগের রাজপুত্র ছিলেন। একদিন তিনি ও তার কিছু সৈন্য মিলে বিনতান দ্বীপে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। শিকারের সময় সে একটা হরিণের পিছু নিতে নিতে একটা ছোট পাহাড়ের কাছে পৌঁছায় কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি আর হরিণকে দেখতে পাচ্ছিলেন না।

 

মালয়েশিয়াতে বসে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন লী কুয়ান ইউ 

তারপর হরিণটিকে দেখার জন্য সামনে থাকা একটা বড় পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার সিদ্ধান্ত নেন। পাহাড়ে ওঠার পর তিনি দেখতে পেলেন আরও একটা দ্বীপ। তার মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জানতে পারলেন দ্বীপটির নাম 'তেমাসেক' এবং তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য তার লোকজনকে আদেশ করলেন। তারপর জাহাজে চড়ে তেমাসেক দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন রাজপুত্র স্যাং নিলা।

পথিমধ্যে তার জাহাজ সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঝড়ের তাণ্ডবলীলা বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি জাহাজ থেকে ভারি মালামাল ফেলে দেওয়ার আদেশ দেন। তবুও কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ঝড়ের গতি বেড়েই চলেছিল। ফলে জাহাজের ক্যাপ্টেন, রাজপুত্র স্যাং নিলা উতামাকে তার স্বর্ণের মুকুট সাগরে ফেলে দেওয়ার কথা বললেন। ফলে ক্যাপ্টেনের কথা অনুযায়ী স্যাং নিলা তার মাথার মুকুট সমুদ্রে ফেলে দিয়ে প্রকৃতির কাছে যেন কোরবানি দিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মত কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ঝড় থেমে যায় এবং তারা সবাই 'তেমাসেক' দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছে যান।

পথিমধ্যে বিশ্রামের কিছুক্ষণ পরে তিনি দ্রুতগতিতে জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া একটি প্রাণী দেখতে পান। তিনি ভাবলেন এটি নিশ্চয়ই সিংহ। এরপর রাজপুত্র স্যাং নিলা সেখানে বসবাস করা শুরু করলেন এবং কয়েক দিনের মধ্যে একটা শহর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শহরটির নাম দিলেন 'সিঙ্গাপুরা' যাকে বলা হয় সিংহের শহর।

বলা হয়ে থাকে, সিঙ্গাপুর শব্দটি এসেছে মালয়েশিয়ান শব্দ 'সিঙ্গাপুরা' থেকে। আর সিঙ্গা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'সিমহা' থেকে যার অর্থ সিংহ এবং 'পুরা' শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় শহর। সুতরাং সিঙ্গাপুর শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সিংহের শহর।

তবে সবথেকে মজার বিষয় হল, সিঙ্গাপুরে কিন্তু কোনো সিংহ নেই। ধারণা করা হয় সে সময় রাজপুত্র স্যাং নিলা উতামা যে প্রাণিটাকে দেখতে পেয়েছিলেন সেটি আসলে সিংহ ছিল না, ছিল মালয়েশিয়ান বাঘ। যাকে মালয়েশিয়ান ভাষায় বলা হয় হারিমাউ। এই হরিমাউ অর্থাৎ বাঘ বর্তমানে শোভাপায় মালয়েশিয়ার পুলিশের লোগো থেকে জাতীয় লোগোতেও।

আসলে স্বাধীনতা' শব্দটা যেকোনো জাতির জন্যই গৌরবের, মর্যাদার। বহু রক্ত, প্রাণ আর ইজ্জতের বিনিময়েই আসে স্বাধীনতা কিন্তু তার বিপরীত সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা। এ যেন ইস্টে অনিষ্ট লাভ অর্থাৎ বিপদের মধ্যে পাওয়া এক সোনার হরিণ।

 সিঙ্গাপুরের প্রথম স্বাধীনতা মার্চিং অনুষ্ঠান। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাস বলছে, ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয় মালয়েশিয়া। তার ৬ বছর পরেও সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক নেতারা চেয়েছিলেন মালয়েশিয়ার অংশ হিসেবে থাকতে। কিন্তু কেন জানি দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ঠিক ব্যাটে-বলে মিলছিল না। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার অংশ হিসেবে যোগদানের সাথে সাথেই দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে ১৯৬৪ সালে জাতিগত দাঙ্গা বেধে যায় মালয় আর সিঙ্গাপুরের চাইনিজদের মধ্যে। এই দাঙ্গার মূল কারণ হিসেবে মালয়রা বিশ্বাস করে, 'সিঙ্গাপুর পিপলস অ্যাকশন পার্টি'র মালয়েশিয়া ফেডারেল ইলেকশনের ফলাফলকে বর্জন করা। যদিও পরে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা করে- এই দাঙ্গার পেছনে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্টদের ইন্ধন ছিল। আর এদিকে সিঙ্গাপুর দাবি করে এটা আসলে মালয়েশিয়া সরকারেরই চক্রান্ত।

পরে ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী 'টুংকু আব্দুল রহমান' প্রস্তাব করেন সিঙ্গাপুরকে ঘাড় ধরে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। আর সেই বছরেই সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়ান ফেডারেল ইউনিয়ন থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে সিঙ্গাপুর পেয়ে যায় স্বাধীনতা।

আর এখন যেন এই সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মালয়েশিয়ানরা। কয়েক বছরের ব্যবধানে আজকের সিঙ্গাপুর বিশ্ববাসীর কাছে যেন এক অপার বিস্ময়, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ব্যবসা, চিকিৎসা ও উদ্ভাবন থেকে শুরু করে গোপনীয় রাজনৈতিক আড্ডার আসর যেন মাত্র ৭২৮.৬ বর্গ কিলোমিটারের এই সিঙ্গাপুরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ডাটা অনুসারে ২০২৩ সালে তাদের মোট জিডিপি ৭৫৭.৭২৬ বিলিয়ন ডলার। যা বিশ্বের ৩৮ তম অর্থনীতি।