শতাধিক মসজিদ ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ করল জার্মান তরুণ

শতাধিক মসজিদ ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ করল জার্মান তরুণ

ছবিঃ সংগৃহীত।

জার্মান তরুণ বিলাল হিগো গবেষণার কাজে ১৯টি দেশ ভ্রমণ করে শতাধিক মসজিদ ভ্রমণ করেছেন। মূলত আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জন ও মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভের লক্ষ্যে তিনি মসজিদে দীর্ঘ সময় কাটান। নামাজের পাশাপাশি মসজিদকেন্দ্রিক পড়াশোনা, গবেষণা ও অন্যান্য কাজে বড় একটি সময় পার করেন তিনি। ফলে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

কিন্তু করোনাকালে মসজিদ বন্ধ হওয়ায় অনেক মুসলিমের মতো তাঁরও মানসিক যাতনা তৈরি হয়। মুসলিম পরিচয়ের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করে নিজের বিশ্বাসকে নতুন করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস ছিল মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস। একদিন রাসুল (সা.) ইবনে উমর (রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘তুমি পৃথিবীতে মুসাফির বা পথিকের মতো বসবাস কোরো।

’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬)

বিলাল ইংল্যান্ডের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এরপর ২০২১ সালে তিনি ‘জার্মানির মুসলিমদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় সংকট’ বিষয়ক গবেষণার কাজ সম্পন্ন করেন। এ বিষয়ে গবেষণার কাজে তাকে উল্লেখযোগ্য সময় মসজিদে ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে তিনি একজন কাউন্সেলিং থেরাপিস্ট ও কালচারাল সাইকোলজিস্ট রিসার্চার হিসেবে কাজ করছেন।

শিগগিরই তিনি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করবেন।

বিলালের মতে সারা বিশ্বের মুসলিম সমপ্রদায়ের বৈচিত্র্য উপলব্ধি ও তা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ধরনের পবিত্র স্থানগুলোর ভ্রমণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত দুই বছর তিনি তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, বসনিয়া, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, মিসর ও সৌদি আরবসহ বিশ্বের ১৯টি দেশ ভ্রমণ করেন। এসব দেশের অনেক মসজিদ ভ্রমণ করে সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন এবং মুসলিমদের বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির চেষ্টা করেন।

অতঃপর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আধ্যাত্মিক ভ্রমণের অংশ হিসেবে তিন সপ্তাহের জন্য জার্মানির মিউনিখ থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান বিলাল।

বিমানে ঊঠে এই ভ্রমণের সব নামাজ বিভিন্ন মসজিদে আদায়ের কথা ভাবছিলেন তিনি। বিলাল বলেন, আমি যদি ২১ দিনের নামাজগুলো ভিন্ন ভিন্ন মসজিদে একসঙ্গে আদায় করি তাহলে মোট ১০৫টি মসজিদে নামাজ পড়া হবে। এমন ভাবনার পরপরই অন্য ফ্লাইটে থাকা আমার বন্ধু করিমকে বিষয়টি অবহিত করি।’ এরপর শুরু হয় উভয়ের এক শ মসজিদ ভ্রমণের পর্ব।

১৬১৬ সালে নির্মিত তুরস্কের ঐতিহাসিক ব্লু মসজিদ ভ্রমণের মাধ্যমে বিলাল ও করিমের ভ্রমণ শুরু হয়। এরপর তারা বিলেসিক, আফিয়ন, আকসারে ও জোংগুলডাক প্রদেশ ভ্রমণ করেন। এসব স্থানে পর্যটকদের তেমন যাতায়াত না থাকলেও স্থানীয় অনেক মসজিদ তারা পরিদর্শন করেন। বসনিয়ার সারাজেভোতে উমর বিন খাত্তাব মসজিদে নামাজ পড়ার মাধ্যমে তাদের এক শ মসজিদ ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন হয়। তুরস্কের আকসারায় প্রদেশের আনাতোলিয়ান শহরে অবস্থিত একটি ছোট্ট মসজিদ খুবই ভালো লেগেছে বলে জানান বিলাল। কেয়া কামি নামক গুহায় শক্ত পাথর খোদাই করে তা তৈরি করা হয়।

বিলাল বলেন, গুগল করে একটি মসজিদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাথরে খোদাই করা এই মসজিদের সন্ধান পাই। খুবই সাধারণ অনাড়ম্বর ও বিনম্র এ মসজিদের কথা আমি কখনো ভুলব না। তা আমাকে পবিত্র কোরআনে সুরা রহমানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কারণ এতে মুমিনদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। করিম সেখানে আজান দেওয়ার পর আমরা একসঙ্গে নামাজ পড়ি। দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণকালে কেপেটাউনের রবেন দ্বীপের একটি মসজিদে নামাজ পড়ার কথাও জানান বিলাল। কারণ সেখানে নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর ২৭ বছরের কারাবাসের শেষ ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন।

যেকোনো দেশে গেলে মসজিদের মুসল্লিরা বিলালকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। বিলাল মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করেন এবং তাদের ইসলামচর্চার নানা দিক অনুভবের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমি মসজিদে নামাজ পড়লে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ আমাকে ডলারের অধিকারী বা পর্যটক হিসেবে মনে করে না। বরং তারা আমাকে তাদেরই একজন মনে করে। বাহ্যিকভাবে মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। তবে কারো মনে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে পারলে সে আপনাকে তার ঘরে নিয়ে যাবে। এর মাধ্যমে আপনার জানার জগতের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

মসজিদ ভ্রমণের মূল শিক্ষা প্রসঙ্গে বিলাল বলেন, মুসলিম সমাজে গায়ের রং বা জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মুসলিম হলেই সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা দেখা যায়। তাই কোরআনের সুরা হুজরাতে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ, আমি তোমাকে পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের জাতি ও গোষ্ঠীতে রেখেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার।’ তাই জাতি, গোষ্ঠী, রং সব কিছু পারস্পরিক পরিচয়ের একেকটি সূত্র।

তথ্যসূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড