দানে সম্পদ কমে না বরং বাড়ে

দানে সম্পদ কমে না বরং বাড়ে

প্রতীকী ছবি।

আপাত দৃষ্টিতে বা খোলা চোখে আমরা দেখি দান করলে সম্পদ কমে যায়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত ও বিকশিত করেন। আর আল্লাহ অকৃতজ্ঞ দুস্কৃতিকারীকে পছন্দ করেন না।”(সুরা বাকারা:২৭৬)

সুদে সম্পদ বাড়ে আর দানে সম্পদ কমে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা বলেছেন সুদে সম্পদ কমে আর দানে সম্পদ বাড়ে। মুফাস্সিরগণ এই বিষয়টি কয়েকটি ভাগে আলোচনা করেছেন। “সুদে সম্পদ কমে এবং দানে সম্পদ বাড়ে” অকাট্য সত্য এ ঘোষণা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে যেমন সত্য তেমনি অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক দিক দিয়েও সত্য। সুদের মাধ্যমে অর্থ বৃদ্ধি হচ্ছে এবং দানের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ কমে যাচ্ছে তবুও প্রকৃত সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান হচ্ছে এই যে, সুদ নৈতিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক উন্নতির কেবল প্রতিবন্ধকতাই নয় বরং অবনতির সহায়ক। বিপরীতপক্ষে দান-খয়রাত, করজে হাসানার মাধ্যমে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বৃত্তি এবং তামাদ্দৃুনিক ও অর্থনীতি সবকিছুই উন্নতি ও বিকাশ লাভ করে। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বিচার করলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে সুদ আসলে স্বার্থপরতা, কৃপণতা, সংকীর্ণতা, নির্মমতা ও পরশ্রীকাতরতা ইত্যকার অসৎ গুণাবলীর ফল এবং এই গুণগুলোই সে মানুষের মধ্যে বিকশিত করে। অন্যদিকে দানশীলতা, সহানুভূতি, উদারতা, পরশ্রীপরায়ণতা ও মহানূভবতা ইত্যকার গুণাবলীই দান-খয়রাতের জন্ম দেয় এবং দান-খয়রাতের মাধ্যমে আর নিয়মিত দান করতে থাকলে এই গুণগুলো মানুষের মধ্যে লালিত ও বিকশিত হতে থাকে।

তামাদ্দুনিক দিক দিয়ে বিচার করলে প্রত্যেক ব্যক্তি নিসন্দেহে এ কথা বুঝতে সক্ষম হবে যে, যে সমাজের লোকেরা পরস্পরের সাথে স্বার্থবাদী আচরণ করে , নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লাভ ছাড়া নিস্বার্থভাবে অন্যের কোন কাজে করে না, একজনের প্রয়োজন ও অভাবকে অন্যজন নিজের মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ মনে করে তা থেকে পুরোপৃরি লাভবান হয় এবং ধনীদের স্বার্থ সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, সে সমাজ কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। সে সমাজের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্কের পরিবর্তে হিংসা, বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা ও অনাগ্রহ মাথাচারা দিয়ে উঠবে। সমাজের বিভিন্ন স্তর সর্বদা বিশৃংখলা ও নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। অন্যান্য কারণগুলো যদি এই অবস্থার সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এহেন সমাজের বিভিন্ন অংশের পরস্পরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে যাওয়াটাও মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।

অন্যদিকে যে সমাজের সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহানুভূতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যার সদস্যরা পরস্পরের সাথে ঔদার্যপূর্ণ আচরণ করে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যের প্রয়োজন ও অভাবের সময় আন্তরিকতার সাথে ও প্রশস্তমনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং একজন সামর্থ ও সক্ষম ব্যক্তি তার একজন অক্ষম ও অসমর্থ ভাইকে সাহায্য অথবা কমপক্ষে ন্যায়সংগত সহায়তার নীতি অবলম্বন করে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক প্রীতি, কল্যাণাকাংখা ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এ ধরণের সমাজে অংশগুলো একটি অন্যটির সাথে সংযুক্ত ও সম্পর্কিত থাকবে। সেখানে আভ্যন্তরিন কোন্দল, বিরোধ ও সংঘাত মাথাচারা দিয়ে উঠার কোন সুযোগই পাবে না। পারস্পরিক শুভেচ্ছা ও সাহায্য সহযোগীতার কারণে সেখানে উন্নতির গতিধারা প্রথম ধরণের সমাজের তুলনায় অনেক বেশী দ্রুত হবে। এবার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করা যাক। অর্থনৈতিক বিচারে সুদী লেনদেন দুই ধরণের হয়। এক, অভাবীরা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যয়ভার বহন করার জন্য বাধ্য হয়ে ঋণ গ্রহণ করে। দুই, পেশাদার লোকেরা নিজেদের ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প, কারিগরী, কৃষি ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করার জন্য যে ঋণ গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রথম ধরণের ঋণটি সম্পর্কে সবাই জানে, এর ওপর সুদ আদায় করার পদ্ধতি, মারাত্মক ধ্বংসকর। দুনিয়ায় এমন কোন দেশ নেই যেখানে মহাজনরা ও মহাজনী সংস্থাগুলো এই পদ্ধতিতে গরীব, শ্রমিক, মুজুর ও স্বল্প আয়ের লোকদের রক্ত চুষে চলছে না। সুদের কারণে এই ধরণের ঋণ আদায় করা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিণ বরং অনেক অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঋণ দিয়ে ঋণ আদায় করে, এভাবে দিনের পর দিন ঋণের বহর বড় হতে থাকে। এক সময় সে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ঋণ পরিশোধ করার কারণে যা সে উপার্জন করে তা মহাজনের পেটে ঢুকে। নিজের পরিবার পরিজনের খাদ্য যোগান তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে সে রোগ-পীড়ায় অসুন্থ হয়ে পড়ে। টাকার অভাবে সুচিকিৎসা করতে পারে না। এভাবে সুদী ঋণের অবস্থা দাঁড়ায় গুটিকয় লোক লাখো লোকের রক্ত চুষে মোটা হতে থাকে কিন্তু সামগ্রীকভাবে সমগ্র জাতির অর্থ উৎপাদন সম্ভাব্য পরিমাণ থেকে অনেক কমে যায়। পরিণামে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ত চোষারাও রেহাই পায় না। কারণ তাদের স্বার্থগৃধৃনতায় সাধারণ দরিদ্র শ্রেনীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে একদিন ক্ষোভের আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে। এবার দান-খয়রাতের অর্থনৈতিক প্রভাব ও ফলাফলের কথায় আসা যাক। সমাজের লোকেরা যদি নিজেদের অবস্থা ও মর্যাদা অনুসারে নিসংকোচে নিজের ও পরিবার পরিজনদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নেয় এরপর তাদের কাছে যে পরিমাণ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে তা গরীবদের মধ্যে বিলি করে দেয় যাতে তারাও নিজেদের প্রয়োজনের জিনিসপত্র কিনতে পারে, তারপরও যে টাকা বাড়তি থেকে যায় তা ব্যবসায়াদের বিনাসুদে ঋণ দেয় অথবা অংশীদারী নীতির ভিত্তিতে তাদের লোভ-লোকসানের শরীক হয়ে যায় অথবা সমাজ ও সমষ্টির সেবায় বিনিয়োগ করার জন্য সরকারের হাতে সোপর্দ করে দেয় তাহলে এহেন সমাজে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদি চরম উন্নতি লাভ করবে। সমাজের সাধারণ লোকদের সচ্ছলতা বেড়ে যেতে থাকবে এবং সুদী অর্থ ব্যবস্থা ভিত্তিক সমাজের তুলনায় সেখানে সামগ্রীকভাবে অর্থ উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে, একথা যে কেউ সামান্য চিন্তা ভাবনা করলে সহজেই বুঝতে পারে।

অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তার মৌলিক প্রয়োজনের চাইতে বেশী অংশ পেয়েছে একামত্র সেই ব্যক্তিই সুদে টাকা খাটাতে পারে। কোন ব্যক্তি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই যে অংশটা পায় কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় আল্লাহর দান। আর আল্লাহর এই দানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, আল্লাহর যেভাবে তাঁর বান্দাকে দান করেছেন বান্দাও ঠিক সেভাবে আল্লাহর অন্য বান্দাদেরকে দান করবে। যদি সে এমনটি না করে বিপরীতপক্ষে আল্লাহর এই দানকে এমনভাবে ব্যবহার করে যার ফলে অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর যেসব বান্দা প্রয়োজনের কম অংশ পেয়েছে তাদের এই কম অংশ থেকেও নিজের অর্থের জোরে এক একটি অংশ নিজের দিকে টেনে নিতে থাকে, তাহলে আসলে সে এক দিকে যেমন হবে অকৃতজ্ঞ তেমনি অন্য দিকে হবে জালেম, নিষ্ঠুর, শোষক ও দুশ্চরিত্র।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে নবী! তাদেরকে বলো, “আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকে চান মুক্ত হস্তে রিযিক দান করেন এবং যাকে চান মাপাজোপা দেন। যা কিছু তোমরা ব্যয় করে দাও তার জায়গায় তিনি তোমাদের আরো দেন, তিনি সব রিযিকদাতার চেয়ে ভাল রিযিকদাতা।”(সুরা সাবা:৩৯)
হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। নবী সা: বলেছেন. মহান আল্লাহ বলেছেন.“হে আদম সন্তানেরা! তোমরা অকাতরে দান করতে থাক, আমিও তোমাদের উপর ব্যয় করব।” নবী সা: আরও বলেন, আল্লাহর ডান হাত প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাত দিন অনবরত ব্যয় করলেও তা মোটেই কমছে না।”(মুসলিম: ২১৯৮, হাদিস একা: বুখারী: ৪৬৮৪,৫৩৫২ কিতাবুয যাকাত, বাবু হাচ্চি আ’লান নাফকাতে,,,,,,,,,)

হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, কৃপণ ও দানশীলদের উদাহরণ হচ্ছে, এমন দু’ ব্যক্তির মতো যাদের পরনে দু’টো লৌহবর্ম রয়েছে। অত:পর দানশীল ব্যক্তি যখন দান করার ইচ্ছা করে তখন তার বর্ম প্রশস্ত হয়ে যায় এমনকি তার চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলে। কিন্তু যখন কৃপণ ব্যক্তি দান করার ইচ্ছা করে তখন তা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। এবং তার হাত গলার সাথে আটকে পড়ে আর গ্রন্থি একটির সাথে অন্যটির সাথে এঁটে যায়। বর্ণনাকারী বলেন, অত:পর আমি রাসুলুল্লাহ সা: কে বলতে শুনেছি: তারপর সে তা প্রশস্ত করার চেষ্টা করে কিন্তু তা করতে সক্ষম হয় না।(মুসলিম: ২২৫১, হাদিস একা: বুখারী: ১৪৪৩,২৯১৭ কিতাবুয যাকাত, বাবু মাছালিল মুনফিকি ওয়াল বাকিলে)

প্রকৃত সত্য হলো, রিযিক কম বেশী হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সর্ম্পর্কিত। আল্লাহ ইচ্ছা অনুসারে ভাল-মন্দ সব রকম মানুষকে তিনি রিযিক দেন। যারা আল্লাহকে মেনে নিয়েছে তারাও রিযিক পাচ্ছে এবং তাঁকে অস্বীকার করে তারাও। প্রচুর রিযিক লাভকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবার প্রমাণ করে না। আবা অন্যদিকে কম রিযিক লাভ বা রিযিকের অভাব বা অভাবগ্রস্তের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হবার আলামত পেশ করে না। আল্লাহ ইচ্ছা অনুযায়ী একজন জালেম এবং বেঈমান লোকও আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়। অথচ জুলুম ও বেঈমান আল্লাহর পছন্দ নয়। অন্য একজন সত্যাশ্রয়ী ও ঈমানদার ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কষ্ট সহ্য করতে থাকে অথচ আল্লাহ সত্যবাদিতা ও ঈমানদারী পছন্দ করেন। কাজেই বস্তুগত স্বার্থ ও মুনাফা অর্জনকে যে ব্যক্তি ভাল মন্দের মাপকাঠি গণ্য করে সে বিরাট ভুলের শিকার ও পথভ্রষ্ট। আসল জিনিস হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং এটি অর্জিত হয় এমন সব নৈতিক গুণাবলীর মাধ্যমে যা আল্লাহ পছন্দ করেন। এ গুণাবলীর সাথে কেউ যদি দুনিয়ার নিয়ামতগুলোও লাভ করে, তাহলে নিসন্দেহে তা হবে আল্লাহর দান এবং এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি নৈতিক গুণাবলীর দিক দিয়ে আল্লাহর বিদ্রোহী ও নাফরমান বান্দা হয়ে থাকে এবং এ সংগে দুনিয়ার নিয়ামতও দান করা হয়, তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় যে, সে কঠিন জবাবদিহি ও নিকৃষ্টতম শাস্তি ভোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে সম্পদের মালিক আমি নিজেই, কারণ এগুলো আমারই শ্রম. মেধা ও যোগ্যতার ফসল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্পদের মুল মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাঁরই একান্ত দয়ায় মাটি, মেঘ-বৃষ্টি,পানি, আলো, বাতাস ও সুর্য প্রভৃতির মাধ্যমে এ সম্পদ আমি পেয়েছি। এমন কি আমার যে যোগ্যতার কথা বলা হয়, তাও আল্লাহরই দান। কাজেই আসমানী এ দানের জন্য সম্পদের একাংশ যাকাতের জন্য স্থিরিকৃত থাকা উচিৎ। তাছাড়া সমাজের কিছু লোক উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যক্রমে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করে থাকে, পক্ষান্তরে কিছু লোকের সম্পদ প্রয়োজনের চেয়ে কম থাকে অথবা প্রয়োজনই মেটাতে পারে না। ইসলাম এ দু’য়ের জবপড়হপরষরধঃরড়হ বা সমন্বয় সাধনের জন্য যাকাত বা দানের গুরুত্বারোপ করেছে অত্যাধিক। দান করলে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়, তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, ফলে উৎপাদন বেড়ে যায়, তখন দানকারীর ব্যবসার বিক্রয় বেড়ে যায়। দানকৃত সম্পদ তার কাছে আবার ফিরে আসে। এভাবে অর্থনীতির সাইকেল দ্রুতগতি লাভ করে।

লেখক: জাফর আহমাদ, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।