ফ্রান্সকে হটিয়ে রাশিয়াকে স্বাগত জানাতে চায় নাইজারের মানুষ

ফ্রান্সকে হটিয়ে রাশিয়াকে স্বাগত জানাতে চায় নাইজারের মানুষ

ফ্রান্সকে হটিয়ে রাশিয়াকে স্বাগত জানাতে চায় নাইজারের মানুষ

আফ্রিকার দেশ নিজেরে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেদেশে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে বৈরিতা ক্রমশ বাড়ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমের জোরালো সমর্থন আছে এমন এলাকাতেও সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীকে দেখা গেল রাশিয়ার পতাকার রঙে পোশাক পরে গর্বের সাথে নিজেকে প্রদর্শন করতে।নিজেরে এই অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটির সামরিক বাহিনীর সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র বাকযুদ্ধ চলছে।

 

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাজুম তাদের দেশের ইসলামি উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। একই সাথে এসব দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

নিজেরে ফ্রান্সের একটি সামরিক ঘাঁটি আছে। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ নাইজার। পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। নিজেরে উৎপাদিত ইউরেনিয়ামের এক চতুর্থাংশই রফতানি হয় ইউরোপে। এরমধ্যে বেশিরভাগটাই যায় সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সে।গত ২৬ জুলাই জেনারেল আবদুরাহমানে টিচিয়ানি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নাইজারের প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর রাস্তায় হঠাৎ করে রুশ পতাকার আবির্ভাব ঘটল।

রোববার রাজধানী নিয়ামিতে এক প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। সেখানে অনেক মানুষের হাতে ছিল রুশ পতাকা। সেদিন কিছু মানুষ এমনকি ফরাসী দূতাবাসে আক্রমণ চালায়।এখন মনে হচ্ছে এই ‘আন্দোলন’ এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।রাজধানী থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর জিন্দেরের যে ব্যবসায়ী রুশ পতাকার রঙে পোশাক পরেছিলেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি। ছবিতে তার মুখ ঝাপসা করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

তিনি বলছিলেন, ‘আমি রুশ পন্থী এবং আমি ফ্রান্সকে পছন্দ করি না। ছোটবেলা থেকেই আমি ফ্রান্সের বিপক্ষে। ওরা আমাদের দেশের সব সম্পদ শোষণ করেছে। ইউরেনিয়াম, পেট্রোল এবং স্বর্ণ থেকে সবকিছু। এই ফ্রান্সের কারণেই আমার দেশের গরিব মানুষেরা তিন বেলা খেতে পায় না।’এই ব্যবসায়ী বলেন, জিন্দের শহরে সোমবার সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তাতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন।

তিনি জানান, স্থানীয় এক দর্জিকে তিনি বলেছিলেন রাশিয়ার পতাকার রঙ সাদা, নীল এবং লাল কাপড় দিয়ে তাকে একটি পোশাক তৈরি করে দিতে। দুটি রুশপন্থী গ্রুপ এই পোশাক তৈরির অর্থ দিয়েছে এমন কথা তিনি অস্বীকার করেন।নাইজারের জনসংখ্যা দুই কোটি ৪৪ লাখ। দেশটির প্রতি পাঁচ জনের দুজন খুব দারিদ্রের মধ্য বাস করে।প্রেসিডেন্ট বাজুম ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০২১ সালে এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এটিকে দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতাবদল বলে বর্ণনা করা হচ্ছিল।

কিন্তু তার সরকার ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং আল-কায়েদার সাথে সম্পর্কিত উগ্রবাদীদের হামলার টার্গেটে পরিণত হয়। সাহারা মরুভূমির একাংশ এবং দক্ষিণের সাহেল অঞ্চলের আধা শুষ্ক অঞ্চলে এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা আছে।নাইজারের প্রতিবেশী দুটি দেশ মালি এবং বারকিনা ফাসোও সাবেক ফরাসী উপনিবেশ। এই দুটি দেশও উগ্রবাদীদের হামলার মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছিল। এই দুটি দেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। উগ্রদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে বলে যুক্তি দেয়া হয়।

নাইজারের মতো এই দুটি দেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ফরাসী সেনা মোতায়েন ছিল। ইসলামপন্থী উগ্রদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফরাসী সেনারা সাহায্য করছিল। কিন্তু উগ্রবাদীদের হামলা অব্যাহত থাকলে সেখানে ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। এই তিনটি দেশের মানুষই অভিযোগ করতে থাকে যে, ফ্রান্স আসলে ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের দমনে যথেষ্ট সাহায্য করছে না।মালিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সেখান থেকে ফ্রান্সের সৈন্যদের বের করে দেয়। এরপর তারা রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপকে ডেকে আনে। জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী দলকেও দেশত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছে মালি।

মালিতে অবশ্য ইসলামপন্থী উগ্রবাদের হামলা অব্যাহত আছে। এদিকে বারকিনা ফাসোর সরকারও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে এবং শত শত ফরাসী সৈন্যকে বহিষ্কার করে।সাবেক প্রেসিডেন্ট বাজুমের সরকার নাইজারের ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ প্রায়শই নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেন।গত বছরের মাঝামাঝি হতে নাইজারের কিছু নাগরিক সংগঠন ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। মালি থেকে যখন ফরাসী সৈন্যদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন বাজুমের প্রশাসন এই সৈন্যদের নাইজারে মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরই এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।

এসব নাগরিক সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটির নাম এম-৬২ আন্দোলন। একদল রাজনৈতিক কর্মী ২০২২ সালের অগাস্টে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলন এবং ট্রেড ইউনিয়নকে জোটবদ্ধ করার মাধ্যমে। তারা নাইজারে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, দুঃশাসন এবং ফরাসী সৈন্যদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়।কিন্তু এই জোটের বিভিন্ন বিক্ষোভ হয় নিষিদ্ধ নয়তো সহিংস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে নাইজারের সরকার। আন্দোলনের নেতা আবদোলায়ে সেইদুকে গত এপ্রিল মাসে আটকের পর ‘জন-শৃঙ্খলা ভঙের’ অভিযোগে তাকে নয় মাসের জেল দেয়া হয়।

প্রেসিডেন্ট বাজুম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এম-৬২ এখন নতুন করে চাঙ্গা হয়েছে।রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এই সংগঠনের কর্মীদের সামরিক জান্তার পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করার ডাক দিতে দেখা গেছে। একইসাথে তারা অভ্যুত্থানের কারণে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞারও সমালোচনা করেছেন।নাইজারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সেইফগার্ডিং দ্য হোমল্যান্ডের (সিএনএসপি) সাথে বা রাশিয়ার সাথে এই এম-৬২-এর কী সম্পর্ক তা স্পষ্ট নয়।

তবে রোববার রাজধানীতে যে বিক্ষোভ হয়, তার মূল আয়োজক ছিল এই সংগঠন। সেখানে অন্য নাগরিক সংগঠনও অংশ নেয়, যাদের মধ্যে ছিল ‘কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর দ্য ডেমোক্রেটিক স্ট্রাগল (সিসিএলডি), বাকাটা এবং ইয়ুথ একশন ফর নিজের।জিন্দের শহরের রুশ-পন্থী ব্যবসায়ী অবশ্য আশাবাদী যে তার দেশকে মস্কো সাহায্য করতে পারবে।তিনি বলছেন, ‘আমি চাই রাশিয়া আমার দেশকে খাদ্য এবং নিরাপত্তা দিয়ে সাহায্য করুক। রাশিয়া আমাদের কৃষির উন্নতিতেও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে পারে।’

তবে জিন্দেরের একজন কৃষক মুতাকা এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, সামরিক অভ্যুত্থান মূলত দেশের সব মানুষের জন্যই দুঃসংবাদ।তিনি আরো বলেন, ‘আমি চাই না রুশরা এদেশে আসুক। কারণ এরা সবাই এলে ইউরোপিয়ান এবং কেউই এলে আমাদের সাহায্য করবে না। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি এবং আমরা সবাই যেন শান্তিতে থাকতে পারি, সেটাই আমি আশা করি।’

সূত্র : বিবিসি