১৯৭৬ সালে শুরু করে বর্তমানে শেয়ারবাজারে কোম্পানি ৪২ গুন বেড়েছে

১৯৭৬ সালে শুরু করে বর্তমানে শেয়ারবাজারে কোম্পানি ৪২ গুন বেড়েছে

প্রতীকী ছবি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৯৬, আর পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০০ কোটি রূপী। এ সময় ডিএসইতে প্রতিদিন ২০ হাজার শেয়ার লেনদেন হতো। স্বাধীনতা লাভের পর সরকার জাতীয়করণ নীতি নেয়। ফলে ডিএসইর কার্যক্রম ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ১৯৭৫ এর পর সরকার জাতীয়করণ নীতি থেকে সরে আসে। এরপরই ১৯৭৬ সালে মাত্র ৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ডিএসই। এখন দাঁড়িয়েছে ৩৭৯ কোম্পানি বর্তমানে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে লেনদেন ৩২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়েছে।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থায় খুবই ভালো। সামনে শেয়ারবাজার আরও ভালো হবে। স্বাধীনতার পর শেয়ারবাজার ব্যাপক উন্নায়ন হয়েছে। এর মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা (ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন) করা, বিএসইসি ‘এ’ ক্যাটাগারিতে উন্নিত হওয়া, সিকিউরিটিজ আইন যুগোপযোগী করা। এছাড়া এসএমই মার্কেট আইন, ক্লিয়ারিং কর্পোরেশন ও ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার চীনকে করা হয়েছে।

শাকিল রিজভী দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে সম্পৃক্ত আছেন পুঁজিবাজারের সঙ্গে। এই দীর্ঘ সময়ে দেখেছেন পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন। পুঁজিবাজার সম্পর্কে রয়েছে তার দেশ বিদেশের ব্যাপক অভিজ্ঞতা। শাকিল রিজভী বলেন, করোনার মধ্যেও দেশে অর্থনীতির সব সূচক ভালো। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বর্তমান বাজারের প্রতি আস্থার সংকটে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। গত কয়েকদিনে পুঁজিবাজারও কিছুটা গতি ফিরে পেয়েছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে আগামী দিনে বাজার ভালো হবে।

শাকিল রিজভী বলেন, আমি বহুবার বলেছি দেশের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই গুজবে কিংবা অন্যের কথার ওপর নির্ভর করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। যার ফল শুভর চেয়ে অশুভই বেশি হয়।

এর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আরও একটি সমস্যা রয়েছে। তারা দ্রুত মুনাফা চান। ব্যবসা করতে চান তিন দিন বা চার দিনের মধ্যে। এই মানসিকতা ঠিক নয়। শেয়ার বাজার ধৈর্যের জায়গা। এখানে কোনোভাবেই ধৈর্য হারালে চলবে না। কেউ ধৈর্য ধারণ করলে তিনি অবশ্যই ফল পাবেন। উল্লেখ্য, শাকিল রিজভী ১৯৮৬ সাল থেকে শেয়ারবাজারের সঙ্গে রয়েছেন। তার মতে, আরও ভালো ভালো কিছু কোম্পানি বাজারে আনতে হবে।
ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেট তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঐ দেশের অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি হলো স্টক মার্কেট। সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে কোনো ব্যাংক অর্থায়ন করে না। ফলে বড় বিনিয়োগ করতে হলে শেয়ার মার্কেটে আসতে বাধ্য কোম্পানিগুলো। আমাদের দেশে ব্যাংক থেকে যতো ইচ্ছা ঋণ নিতে পারে। এক সময় অনেকে খেলাপীও হয়ে যায়।

ঐ দেশে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে টাকা নিয়ে প্রজেক্ট করে, ভালো হলে সবাই উপকৃত হয়। আর খারাপ করলে সবাই এটার ভাগ নেয়। আর এটি আমাদের দেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা পুঁজিবাজারে না এসে ব্যাংক থেকে ১৫, ২০ বা ২৫ বছরে মেয়াদে ঋণ নেয়। এতে কোম্পানি সফল হলে ওর অংশ কিন্তু ব্যাংক পায় না। আর যদি কোনো কারণে প্রজেক্ট ফল করলে ব্যাংক আর টাকা তুলতে পারে না।

এতে করে খেলাপী হয়ে যায়। দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগের টাকা যদি পুঁজিবাজার থেকে নিতো, আমাদের বাজার অনেক বড় হতো। আর যদি বাজার খারাপ হতো, তাহলে সবার দৌঁড়-ঝাপ শুরু হয়ে যেতো।

শাকিল রিজভী আরও বলেন, বড় কোম্পানিগুলোকে আনতে তিনটি বিষয় জরুরি। প্রথমত ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ও মেয়াদ বেঁধে দেওয়া; দ্বিতীয়ত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) এবং তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির কর হারের ব্যবধান বাড়ানো।

ঋণ ও মূলধনের অনুপাত বেঁধে দেওয়া হলে অল্প মূলধনের কোম্পানি বড় ঋণ নিতে পারবে না। আবার মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হলে শুধু চলতি মূলধনের জন্য ঋণ পাওয়া যাবে। তখন চাইলে কোনো কোম্পানি ব্যাংক থেকে বড় ঋণ নিতে পারবে না। তাকে পুঁজিবাজারে আসতেই হবে।

অন্যদিকে এফআরএ হলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। এতে নীরিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজশ করে কোম্পানির আয় কমিয়ে দেখানো বা লোকসান দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে আসবে। এ সুযোগের জন্য অনেকে পুঁজিবাজারে আসতে চায় না। কারণ পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিনিয়োগকারী এবং মিডিয়ার কাছে জবাবদিহী থাকে।

তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে সুদের হার এক ডিজিটে নেমে এসেছে। সে কারণে অনেকেই ব্যাংকের চেয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছেন।

কেউ যদি পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেন তবে বছর শেষে তিনি ব্যাংকের চেয়ে পুঁজিবাজার থেকে ভালো লভ্যাংশ পেতে পারেন। তবে বিনিয়োগটা হতে হবে অনশ্যই ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে। পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বাড়াতে হলে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিকল্প নেই।

স্বাধীতার আগে ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়। ১৯৬২ সালের ২৩ জুন এর নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড রাখা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৪ মে আবার নাম পরিবর্তন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লি. (ডিএসই) রাখা হয়।

১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিক লেনদেন শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে, ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ নারায়ণগঞ্জ চেম্বার বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত হয়। ডিএসই ১৯৫৯ সালে ৯/এফ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় নিজস্ব ভবনে চলে আসে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে ডিএসই নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৯৬, আর পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০০ কোটি রূপী। এ সময় ডিএসইতে প্রতিদিন ২০ হাজার শেয়ার লেনদেন হতো। স্বাধীনতা লাভের পর সরকার জাতীয়করণ নীতি নেয়। ফলে ডিএসইর কার্যক্রম ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ১৯৭৫ এর পর সরকার জাতীয়করণ নীতি থেকে সরে আসে। এরপরই ১৯৭৬ সালে মাত্র ৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ডিএসই। তবে শেয়ারবাজার আলোচনায় আসে ১৯৮৩ সাল থেকে।

এ সময় বাজার পুঁজিকরণ ৮১ কোটি ২০ লাখ টাকায় পৌঁছায়। ১৯৮৭ সালে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৯২টি। তবে শেয়ারবাজার সবার আলোচনায় আসে ১৯৯০-এর পর থেকে। তবে সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল বাজারের দুই ধস। দেশের শেয়ার বাজারের প্রথম ধস নেমেছিল ১৯৯৬ সালে।তখন হাতবদল হত কাগুজে শেয়ারের। এখনকার মতো সেন্ট্রাল ডিপজিটরি ব্যবস্থা ছিল না। বাজারে ছিল জাল শেয়ারের ছড়াছড়ি। মতিঝিল এলাকায় নিত্য যানজট লেগে থাকতো।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেনাবেচা হতো বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে দ্বিতীয় ধস হয়। ২০১০ এর পতনের পরে সবারই আশা ছিল এবার বাজার ঠিক হবে। পতনের পর পরই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত পুনর্গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নতুন মুখ নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান হন এম খায়রুল হোসেন। করা হয় নতুন নতুন আইন। বাজারে আসে নতুন নতুন কোম্পানি। এমনকি এই নেতৃত্ব বহাল থাকে টানা নয় বছর। কিন্তু বাজার ভালো হয়নি।

বলা চলে, মন্দা থেকে দাঁড়াতে পারেনি বাজার। বাজার ঘুরে না দাঁড়ালেও কারসাজি বন্ধ ছিল না, কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তাও ছিল আগের মতো। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি এনে বাজারকে আরও সংকটে ফেল দেয় তারা। শেয়ারবাজারে আবার নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এসেই অবশ্য তিনি নতুন নতুন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। শুরুতেই একটি বার্তা দিতে পেরেছেন তিনি। কিছু করলে পার পাওয়া যাবে না এই বার্তাটাই দিতে পেরেছেন তিনি। অনিয়মের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানিকে বড় অংকের জরিমানা করেছেন।