কর্মক্ষেত্র হোক উপভোগ্য

কর্মক্ষেত্র হোক উপভোগ্য

প্রতীকী ছবি।

কিছুদিন আগে প্রথম আলোর নাগরিক পাতায় একটা লেখা পড়লাম। ‘একটি বেদনাদায়ক সাক্ষাৎকার’। সেই সাক্ষাৎকারের আপাদমস্তক ছিল অফিসকেন্দ্রিক। ঘুম থেকে জাগরণ, ঘর হতে বাহির, ভাবনা থেকে চিন্তা, আড্ডা থেকে অবসাদ, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ঝঞ্ঝা—মোটকথা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত—সবটা জুড়ে ছিল শুধু অফিস, অফিস আর অফিস।

সত্যিই ভেবে দেখুন তো, যাঁরা আমরা চাকরি করি সেটা হোক সরকারি অথবা বেসরকারি, ছোট কিম্বা বড়—সবারই যাপিত জীবন এ চাকরি মানে অফিস ঘিরে। কখন ভোর হয়, কখন সকালের সূর্যের আলো তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় বাড়ির আঙিনাজুড়ে, কখন পাখিরা উড়ে যায় তাদের নিজেদের আপন নিবাস থেকে, তা আমরা দেখতেই পাই না। ভোরের শিশিরের যে স্নিগ্ধতা, বাতাসের যে নরম অনুভূতি, সে স্পর্শ কত দিন যে গায়ে মাখি না, তা মনেই পরে না।

 

সব কিছুর মূলে ওই একটাই পিছুটান, আর তা হলো অফিস। হয়তো অনেকেই বলবে, কেন ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠলেই তো প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। কিন্তু ভোরে উঠেই তো শুরু হয় অফিসে যাবার তাড়া। আমাদের এ ঢাকা শহরে যে যানজট তাতে দূরত্বের কথা চিন্তা করে দুই ঘণ্টা আগেই অফিসের জন্য বের হতে হয়।

ফিরতে ফিরতে কখনো মাঝরাত। তাছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ কর্মজীবী মানুষ এ শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অফিস যাতায়াত করেন। কাজেই এই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আর রাস্তার যানজট এখানেই একজন মানুষের সব এনার্জি নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাসায় ফিরে পুর্ণিমার চাঁদ এবং ভোরের শিশির কিছুই আর টানে না।

যাঁরা আমরা কর্পোরেট চাকরি করি, আমার তো মনে হয় শুধু কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর জন্য আমরা বাসায় ফিরি। এতে করে জীবনের আশপাশের যে রং–রূপ–রস আছে, তার আস্বাদন টেরই পাই না। মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যাই। একঘেয়েমি লাগে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে বা কারও কোনো বিশেষ প্রয়োজনেও অনেক সময় তাঁদের সময় দেওয়া হয় না অফিসের জরুরি মিটি, সেমিনার, প্রজেক্ট এসব নানা ব্যস্ততায়।

তখন মনে হয় জীবনে বোধহয় কাছের মানুষগুলোর চেয়েও এই অফিসটাই মুখ্য। ব্যস্ততার এই জীবনটাকে হাঁপিয়ে উঠতে দেখে মনে হয় জীবনটা বোধহয় কেবলই ভোগের, উপভোগের নয়। আচ্ছা, আমরা কি জীবনের জন্য বাঁচি, নাকি বাঁচার জন্য এই যান্ত্রিক জীবন—ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

কর্মব্যস্ত প্রতিটি মানুষকে দেখলে মনে হয়, সবাই কেমন যেন রেসের ঘোড়ার মতো দৌঁড়াচ্ছেন। কে কাকে ছাপিয়ে কার আগে যাবেন, এমন একটা অস্থির প্রতিযোগিতা চলছে। কারও দুদণ্ড সময় নেই কথা বলার এবং সামাজিকতা–আতিথিয়তার। সব কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ততার ভিরে।

পারিবারিক কোনো আড্ডা বা অনুষ্ঠানে আমরা সময় দিতে পারি না অথচ অফিসের ডিনার পার্টি কিম্বা যেকোনো অফিশিয়াল প্রোগ্রামে আমাদের উপস্থিত থাকতেই হবে সব কিছু উপেক্ষা করে। না হলে বস রাগ করবেন নিজের কাজের জায়গায় অবস্থান নষ্ট হবে। এমনও হয়েছে, রমজান মাসে নিজের মৃত আত্মীয়ের জন্য দেওয়া ইফতার মাহফিলে থাকার সুযোগ হচ্ছে না অথচ অফিসের ইফতার পার্টিতে যেতে হয়েছে কয়েক দফায়। এটা কষ্টদায়ক হলেও এটাই পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা। কখনো কখনো পরিবারের চেয়ে অফিসটাই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, ওটাই আমার-আপনার জীবন এবং জীবিকার একমাত্র পথ।

মাঝেমধ্যে এমনও হয়, বাড়ির লোকেরা যখন বলে অমুক দিনটা বাড়িতে থাকতে পারবি, একটা বিশেষ কাজ আছে। তখনো থাকা সম্ভব হয় না বরং রাগ দেখিয়ে বলি, তোমাদের এই লোক দেখানো সামাজিকতার চেয়ে অফিসটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আজ চাকরিটা আছে বলে তোমাদের কাছে আমি ইম্পর্ট্যান্ট, কাল চাকরিটা চলে যাক, বেকার ঘরে বসে থাকি, তখন আর আমাকে কেউ  খুঁজবে না।
সত্যি বলতে অফিস এমন একটা জায়গা, অনেকটা রাজনীতির মাঠের মতো। কে কাকে ল্যাং মারবে, কে কার ভালো হতে দেবে না, এসবই চলে সব সময়। সব সহকর্মী একরকম হয় না।

আমাদের সমাজে মোটামুটি সবখানেই একটা শ্রেণিবিভেদ আছে। অফিসও এর বাইরে না। অথচ আমরা জেনেছি শিক্ষিত লোকেরা উদার হন। কিন্তু না বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করা ছাড়াও বিবেকের একটা পাঠশালা থাকে, সেই পাঠশালায় অফিস পাড়ার লোকেদের মনে হয় খুব একটা যাওয়া–আসা হয় না। অফিস পলিটিক্স কখনো কখনো মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। আজকাল তো অনেক অফিসে মনোবিদ নিয়োগ দেওয়া হয়।

দেখুন অফিস যে মোটেও সুখের জায়গা নয়, তা আমরা যাঁরা চাকরি করি তাঁরা কম–বেশি অনেকেই জানি। মানসিক চাপ নিয়েও অফিস করতে হয়। আমার তো মনে হয়, শতকরা ৯৯ জন মানুষেরই ধরাবাঁধা নিয়ম ভালো লাগে না। আর যাঁরা একটু সৃজনশীল মানুষ, তাঁদের তো ভালো লাগেই না, কিন্তু বাস্তবতার কাছে সব থমকে যায়। জীবনের তাগিদে আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে উপেক্ষা করতে হয়। মন না চাইলেও ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। এটাই জীবনের নিয়ম।

অফিস মানেই যে প্যারা, অফিস মানেই যে কঠোরতম নিয়ম—তাও কিন্তু সব সময় ঠিক নয়। আমি তো মনে করি অনেক যন্ত্রণার অবসান ঘটায় অফিস। মানসিক চাপ, পারিবারিক কলহ এসব থেকে মুক্তি পেতেও অফিস একটা বড় ভুমিকা পালন করে। আর যাঁরা একাকী নিঃসঙ্গ, তাঁদের কাছে কাজ একটা বড় সঙ্গী তাই এসব একাকী মানুষেরা নিজের কাজের জায়গাটা খুব উপভোগ করেন। তা ছাড়া অফিসের কিছু কিছু সহকর্মী কিন্তু দারুন বন্ধুর মতো হয়। অনেক কিছু অনায়াসে তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়।

কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, তারা সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না। তারা ভাবে এতে বুঝি কাজের চেয়ে গল্পটাই বেশি হবে। এ ভ্রান্ত ধারণা, মোটেও ঠিক নয়। সহকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক যত সহজ হবে, কাজের প্রোডাক্টিভিটি তত ভালো হবে। আমি নিজে এমন ও অফিস দেখেছি, যেখানে ব্যাক্তিগত ফোন জমা দিয়ে অফিসে ঢুকতে হতো, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে কি না তা সব সময় একজন লোক নিয়োগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হতো। এসব প্রতিষ্ঠানে যে বা যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা মানসিকভাবে কতটা ভালো আছেন, তা বুঝে নিতে খুব বেশি মেধাবী হওয়ার দরকার নেই।

যে জায়গায় আমরা দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছি, সেই জায়গাটা যদি আরামদায়ক এবং স্বস্তির না হয়, তাহলে আমরা কাজটা উপভোগ করব কীভাবে? কাজের পরিবেশ যেমন আনন্দায়ক হতে হয়, তেমনি যাঁরা আমাদের দিয়ে কাজটা করিয়ে নিচ্ছেন, তাঁদেরও হতে হয় সহজ এবং প্রাণবন্ত। সময় অনেক বদলে গেছে কাজের ধারাও পাল্টে গেছে। মানুষ এখন কাজে যেমন আধুনিক মননশীলতায়ও অনন্য।

অফিস এমন একটা জায়গা, যা আপনাকে সময়নিষ্ঠ হতে শেখায়। রোজ যখন আপনি সুন্দর পোশাক পরে নিজেকে গুছিয়ে অফিস যাবেন, তখন নিজের কাছেও ভালো লাগবে। এছাড়া সহকর্মীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে খেতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা এসব ছোট ছোট জিনিসগুলো আপনাকে মানসিকভাবে ভালো রাখবে। অনেক ক্লান্তির মধ্যেও একটুখানি প্রশান্তি দেবে।

টানা সাত দিন কাজহীন ঘরে বসে থাকুন, দেখবেন আপনার অস্থির লাগছে। সময় কাটছে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, হাতে টাকা থাকলে মনও ভালো থাকে। যে চাকরিই করুন না কেন, যতটুকু মাইনেই পান না কেন, যখন আপনি সেই টাকা দিয়ে আপনজনদের জন্য কিছু করতে পারবেন, তখন সেই আনন্দের যে উচ্ছ্বাস, তার তুলনা অন্য কিছুর সঙ্গে হয় না।

একটা চাকরি মানে শক্তি, একটা অফিস মানে নিরাপত্তা। হয়তো ভোরের আলোয় নিজেকে মেলে ধরা হয় না, হয়তো তপ্ত দুপুরে শান্ত নদীর বুকে দেখা হয় না, পানকৌড়ির ডানা ঝাপটানো অথবা সময় হয় না বিশেষ দিনে বন্ধুদের সঙ্গে অবাধ আড্ডার। কিন্তু সময়কে যদি একটু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে বোধহয় অনেক কিছুই সম্ভব হয় আর তারচেয়েও বড় কথা হলো, যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সব ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করা যায়।

আসলে প্রাণ ভরে বাঁচতে শিখতে হয়। আমাদের কারুরই বোধহয় চলার পথ খুব একটা সহজ নয়। আমরা আজকাল শুধু তুলনা করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর–ওর স্টাইলিশ ছবি দেখে ভাবি, আহা, কী রঙের জীবন! কিন্তু না জীবনে রং আপনা আপনি আসে না। এলে যতটা আমরা বাইরে থেকে দেখি, ততটা স্নিগ্ধ আর মসৃণ জীবন বাস্তবে খুব কমই হয়। কারও সঙ্গে তুলনা নয়, নিজেকে ভালো রাখতে হয় শুধু নিজের মতো করে। আর আমার মনে ভালো থাকার একমাত্র সহজ পথ নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কাজের ভেতর ডুবে থাকা।

কবি গুরুর ভাষায় বলি—
আমার লাগি করিও না শোক,
আমার আছে কর্ম, আমার আছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই-
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।

লেখক: রোজিনা রাখী