অ্যাথলেটিক্সের দুনিয়ায় ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্বের এক বিরল কাহিনি

অ্যাথলেটিক্সের দুনিয়ায় ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্বের এক বিরল কাহিনি

অ্যাথলেটিক্সের দুনিয়ায় ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্বের এক বিরল কাহিনি

ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে জ্যাভলিন থ্রো-র ফাইনালে ইউরোপিয়ান আর মার্কিনিদের পেছনে ফেলে দুইজন দক্ষিণ এশিয়ান স্বর্ণ আর রৌপ্যপদক জিতছেন, এমন অলৌকিক দৃশ্য কেউ কখনো দেখেননি।কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটে যাওয়ার পরেও রবিবার রাতে বুডাপেস্টে বিস্ময়ে অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল।

জ্যাভলিন থ্রো-র নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নীরজ চোপড়া তখন ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকা নিয়ে ট্র্যাকের পাশেই দাঁড়িয়ে।ফোটো অপরচুনিটির জন্য তার পাশেই ব্রোঞ্জ পদকজয়ী চেক প্রজাতন্ত্রের জ্যাকাব ভ্যাডলেচ, তার হাতেও নিজের দেশের পতাকা।কিন্তু রূপো জেতা পাকিস্তানের আর্শাদ নাদিম গেলেন কোথায়?

নীরজ চোপড়া হঠাৎ খেয়াল করলেন আর্শাদ নাদিম একটু দূরে দাঁড়িয়ে, সম্ভবত পাকিস্তানের একটা জাতীয় পতাকা খুঁজছিলেন তিনি।কিন্তু চট করে হাতের কাছে সেটা পাওয়া গেল না – নীরজ কিন্তু তারপরও পতাকা ছাড়াই ডেকে নিলেন বন্ধু আর্শাদকে, হাসিমুখে এরপর ফোটোগ্রাফারদের সামনে দাঁড়ালেন তিন পদকজয়ী।

একটু পর ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্সেও নীরজ জানালেন, “প্রতিযোগিতার দিন আমি খুব একটা মোবাইল ফোন ঘাঁটি না। আজ কিন্তু মোবাইলে ঢুকেছিলাম, আর ঢুকেই দেখি সেখানে শুধু ভারত-পাকিস্তান নিয়ে চর্চা!”“আর্শাদও যে এত ভাল ছুঁড়েছে তাতে আমি খুবই খুশি ... আমরা দুজনেও আসলে বলাবলি করছিলাম যে কীভাবে আমাদের দুটো দেশ এই খেলাটায় এগিয়ে আসছে।”

“আগে জ্যাভলিন থ্রো-তে শুধু ইউরোপিয়ানদেরই দাপট ছিল। কিন্তু এখন আমরা ওদের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি”, গর্বের সঙ্গে জানান নীরজ চোপড়া।ফাইনালের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই আর্শাদ নাদিমও স্পোর্টস্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উর্দুতে বলেছিলেন, “নীরজভাই, আপনি খুব ভাল করুন, আর আমিও যেন ভাল ছুঁড়তে পারি!”

 “আপনার তো দুনিয়াজোড়া নাম আছেই, আমিও যেন সুনাম কুড়োতে পারি”, অপার সরলতার সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন আর্শাদ।সীমান্তে বা ক্রিকেটের মাঠে যে দুটি দেশ নিরন্তর নিজেদের মধ্যে গোলাবর্ষণ কিংবা হাই-ভোল্টেজ খেলায় মেতে থাকে – তাদের দুজন অ্যাথলিট নিজেদের মধ্যে পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পাশে সরিয়ে রেখে এভাবে পরস্পরকে শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছায় ভাসাচ্ছেন, এ ঘটনা বিরলতম নি:সন্দেহে।

পাকিস্তানের খানেওয়ালের আর্শাদ নাদিম আর ভারতের হরিয়ানার পানিপথের নীরজ চোপড়ার এই অসামান্য বন্ধুত্ব তাই সীমান্তের দুপারেই নেট দুনিয়ার মন জয় করে নিয়েছে।ভারত ও পাকিস্তানের আমজনতা নিজেদের যাবতীয় বাগবিতন্ডা ভুলে আপাতত সোশ্যাল মিডিয়ায় একযোগে কুর্নিশ জানাচ্ছেন তাদের এই দুই ‘হিরো’কে!

আর্শাদ-নীরজের বন্ধুত্ব ও লড়াই

অলিম্পিক গেমস, ডায়মন্ড লীগ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ গেমস বা এশিয়াড – মাত্র ২৫ বছর বয়সেই প্রায় সবগুলো বড় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতে নীরজ চোপড়া সম্ভবত ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন।বুডাপেস্টে গত রাতে মাত্র ৩৫ সেন্টিমিটারের ব্যবধানে যাকে পেছনে ফেলে নীরজ চ্যাম্পিয়ন হলেন – সেই আর্শাদ নাদিমের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতাও প্রায় সাড়ে সাত বছরের পুরনো।

দুই হাজার ষোলো সালের ফেব্রুয়ারিতে আসামের গুয়াহাটিতে সাউথ এশিয়ান গেমসে দুই তরুণ অ্যাথলিটের প্রথম দেখা হয়েছিল। নীরজ স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, আর্শাদ পেয়েছিলেন ব্রোঞ্জ।পরবর্তীতে ভিয়েতনাম, পোল্যান্ড, জাকার্তা, টোকিও, ইউজিন বা অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্ট-সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে দুজনের অন্তত আটবার লড়াই হয়েছে, প্রতিটিতেই আর্শাদকে পেছনে ফেলেছেন নীরজ।তবে কেরিয়ারের সেরা জ্যাভলিন থ্রো-তে আবার নীরজকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন আর্শাদ।

গত বছর বার্মিংহামের কমনওয়েলথ গেমসে তিনি ৯০ মিটারের বেশি দূরত্বে জ্যাভেলিন ছুঁড়েছিলেন, এশিয়ার দ্বিতীয় অ্যাথলিট হিসেবে যে কৃতিত্ব তিনি অর্জন করেন।সেখানে নীরজ চোপড়ার সেরা থ্রো হল ৮৯.৯৪ মিটার – যেটা তিনি সুইডেনে করেন, আর সেটা ভারতের জাতীয় রেকর্ডও বটে।

এত দীর্ঘ সময় ধরে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দুই অ্যাথলিটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্যেও দুজনের বন্ধুত্বে কিন্তু কোনও চিড় ধরেনি – বরং পরস্পরের প্রতি পেশাগত শ্রদ্ধা আর সম্মান ক্রমেই বেড়েছে।জাকার্তা এশিয়াডে ২০১৬ সালে স্বর্ণপদক জেতার পর নীরজ একসঙ্গে ছবি তোলার জন্য ডেকে নিয়েছিলেন ব্রোঞ্জজয়ী আর্শাদকে, দুজনেই নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ‘পোজ’ও দিয়েছিলেন।সেবারেই প্রথম পরস্পরের সম্পর্কে মিডিয়ায় মুখ খুলেছিলেন তারা।আর্শাদ তখন কিছুটা অনুযোগের সুরেও বলেন, “নীরজভাই এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু এখন উনি আর আমার মেসেজের জবাব দেন না। আগে দিতেন, কিন্তু এখন ব্যস্ত বলে বোধহয় আর সময় পান না।”

টোকিও অলিম্পিক্সে জেতার পর নীরজ আবার এক সাক্ষাৎকারে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, প্রথম থ্রো-র পর আর্শাদ তার জ্যাভেলিনটা পাশের বাস্কেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় তিনি সেটা কিছুক্ষণের জন্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না।এই নিরীহ মন্তব্য নিয়ে নানা ধরনের ভারত-পাকিস্তান ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ চালু হয়ে যেতেই নীরজ চোপড়া টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, “এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ঘটনা ছিল।”

“দয়া করে আমার কোনও মন্তব্যকে আপনাদের দুরভিসন্ধি বা প্রোপাগান্ডার কাজে ব্যবহার করবেন না”, সাফ জানিয়ে দেন তিনি।ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া-প্রসূত শত্রুতায় এভাবে ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়ার কাজ ভারত বা পাকিস্তানের আর কোনও ক্রীড়াবিদ কখনও করেছেন বলে জানা নেই।

বস্তুত গত সাত-আট বছরে নীরজ চোপড়া ও আর্শাদ নাদিম বারে বারে প্রমাণ করে দিয়েছেন তারা দুর্দান্ত অ্যাথলিট হিসেবে একে অপরকে ভীষণ সম্মান করেন এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে তারা কিছুতেই ভারত-পাকিস্তান রেষারেষির ছায়া পড়তে দিতে চান না!ঠিক এ জন্যই জাভেদ মিঁয়াদাদ-কিরণ মোরে, এমন কী শোয়েব আখতার-সচিন তেন্ডুলকর বা হকির জগতে দুদেশের দিকপাল তারকাদের চেয়েও এই দুজনকে সাধারণ ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাও একেবারেই অন্য চোখে দেখছেন!

পাকিস্তানিদেরও ‘মেন্টর’ নীরজ

বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে ইতোমধ্যেই ‘লেজেন্ডে’র মর্যাদা পাওয়া নীরজ চোপড়া শুধু ভারতের কোটি কোটি তরুণের জন্যই নয়, প্রতিবেশী পাকিস্তানেও রোল মডেলের মর্যাদা পাচ্ছেন।গত দোসরা অগাস্ট এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে জ্যাভলিন থ্রো-তে ব্রোঞ্জ জেতার পর সে কথা বলেও ফেলেন পাকিস্তানের তরুণ অ্যাথলিট মুহাম্মদ ইয়াসির।

পদক জেতার পর জিও টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়াসির বলেছিলেন, “আমি ভাবতেই পারিনি নীরজভাই আমাকে কনগ্র্যাচুলেট করতে ফোন করবেন। উনি আমাকে সামনের দিনগুলোর জন্যও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।”আবেগাপ্লুত মুহাম্মদ ইয়াসিরের বলতে কোনও দ্বিধা ছিল না, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ‘নীরজভাই’য়ের ফোন তাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে।জ্যাভলিন থ্রো-র মতো ইভেন্টে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা ‘সুস্থ প্রতিযোগিতা’ যে সার্বিকভাবে দুই দেশের পারফরম্যান্সকেই উন্নত করছে সেটাও সীমান্তের দুপারেই সকলে মানছেন।আর এটা ‘ট্রিগার’ করেছে নীরজ চোপড়া এবং আর্শাদ নাদিমের চমৎকার সম্পর্ক।

বস্তুত নীরজ চোপড়া যে ‘খেলা’টাকে সব সময় রাজনীতি বা কূটনীতির আগে রেখেছেন, সে কথাও ভারতে নেটিজেনদের অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ‘ড: নিমো যাদব’ নামে ভারতের একটি জনপ্রিয় হ্যান্ডল থেকে পোস্ট করা হয়েছে, “দু’বছর আগে এই নীরজ চোপড়াই অলিম্পিক্সে তার সতীর্থ আর্শাদ নাদিমকে ট্রোলিংয়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।”

“দু’মাস আগে সেই তিনিই ভারতে প্রতিবাদরত কুস্তিগিরদের সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন।”‘বিজেপির পদলেহন করে নয়, বরং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই’ নীরজ যে নিজের সাফল্য অর্জন করেছেন, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘ড: নিমো যাদব’।নীরজ চোপড়া এবং আর্শাদ মালিকের বিশ্ব মানের পেশাদারি লড়াই ও বিরল বন্ধুত্বের এমন নজির ভারত বা পাকিস্তান যে আগে কখনো দেখেনি – চোখ বন্ধ করে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়!

সূত্র : বিবিসি