কেমন আছেন খালেদা আক্তার কল্পনা

কেমন আছেন খালেদা আক্তার কল্পনা

ছবিঃ সংগৃহীত।

টিভি ও চলচ্চিত্রের বরেণ্য এক অভিনেত্রীর নাম খালেদা আক্তার কল্পনা।

মঞ্চেও টুকটাক অভিনয় করেছেন তিনি। তবে খ্যাতিমান এই অভিনেত্রী মূলত পরিচিতি পেয়েছে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সিনেমাপ্রেমী দর্শক ও চলচ্চিত্র মহলে তাকে ডাকা হয় ‘মমতাময়ী মা’ হিসেবে। নব্বই দশকীয় শৈশব-কৈশোর পার করা যে প্রজন্ম শুক্রবারের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির সময়গুলোতে মায়েদের ভূমিকায় যাদেরকে দেখে বড় হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত মুখ ছিলেন অভিনেত্রী খালেদা আক্তার কল্পনা। তিনি অসংখ্য ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন।

মায়ের প্রতি বাস্তবে আমরা যে চিরন্তন বন্ধন অনুভব করি তার অভিনয়ের মধ্যে সে অনুভূতি পাওয়া যেত। মনে হতো তিনি পর্দায় মায়েদের একজন প্রতিনিধি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারা পাল্টে যাওয়ার কারণে কমে গেছে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও। নায়ক, নায়িকা আর খলনায়ককেন্দ্রিক সিনেমার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে মা-বাবার চরিত্র। যে কারণে এখনকার সিনেমায় খুব একটা দেখা মিলছে না খালেদা আক্তার কল্পনার।

তাছাড়া শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি বাসা বেঁধেছে সদ্য ৭১ বছর বয়সে পা রাখা এই অভিনেত্রীর। অসুস্থ এই অভিনেত্রী অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। তার ডান চোখে গ্লুকোমা, রেটিনায় রক্তপাত ও কর্নিয়ার আলসার থেকে ইনফেকশন হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এখন শুধু বাম চোখ ভরসা। এই অভিনেত্রী জানান, ঢাকায় তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন কিন্তু দেশের চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য চেন্নাই থেকে ছানি অপারেশন করান তিনবার। এরপর কলকাতার শঙ্কর নেত্রালয়ে প্রতি চার মাস পর চিকিৎসা করালেও ডায়াবেটিস থাকায় এই চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। যা তিনি বহন করতে পারছেন না। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অর্থকষ্টে অনেকটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীবন কাটাচ্ছেন প্রথিতযশা এই মডেল অভিনেত্রী।

খালেদা আক্তার কল্পনা বলেন, ‘সংসারের পুরো ভার আমার ওপর। ছোট ভাইকে সন্ত্রাসীরা গুলি করায় তার হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, আরেক ভাই কিডনির সমস্যায় মারা গেছেন। ওদের চিকিৎসার সব খরচ আমি চালিয়েছি। এখন আর এই ভার টানতে পারছি না। আমার হাতে কাজ থাকলে হয়তো এসব সমস্যা হতো না। অসুস্থতার জন্য কোনো কাজই করতে পারি না। আমার আর্থিক অবস্থা এতো খারাপ ছিল না। আমি একটা চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছিলাম। কিন্তু লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাইনি। আর্থিক ক্ষতি হলেও সব সামলে নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রমাগত পুরো সংসারের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে জমাকৃত অর্থও শেষের পথে।’

 

১৯৫৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা আক্তার কল্পনা। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। স্কুল, কলেজে শিক্ষকদের খুব উৎসাহ পেতেন পড়াশোনায়, সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণে।

খালেদা আক্তার কল্পনা জানান, অভিনয়ের জন্য সব সময়ই বাবার উৎসাহ পেতেন। পরিবারে বাবার নিজের থেকেই উৎসাহ দেয়ার ঘটনা খুব কম দেখা যায়। একবার গ্রামে একটা প্রোগ্রামে শিশুশিল্পী পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবা এসে বললেন কাজটা করবে কিনা। তিনি উৎসাহ বোধ করেন। কাজটা করার পর পুরস্কার পেয়ে যান। তখন তার মধ্যে অভিনয় করার চিন্তা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। মনে করলেন অভিনয়টা তাকে দিয়ে হবে।

 

চট্টগ্রাম বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষিকা হিসেবেও কাজ করেছেন খালেদা আক্তার কল্পনা। তবে হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় রেডিওতে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। বিয়ের পর শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। এরপর ১৯৮৪ সালে এফডিসি থেকে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ ঘোষণা করা হলো। একজন খুব উৎসাহ দেন সাড়ে চার হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি টিকবেন। বিশ্বাস না করলেও নির্দিষ্ট তারিখের পর তাকে যোগাযোগ করিয়ে অডিশনে পাঠানো হয়।

অডিশনে গিয়ে ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেন। ইন্টারভিউ কার্ড লেটে আসছে বলে দেন। অডিশন নেয়া হলো এবং তিনি প্রশংসিত হন। তখন অডিশনে বিচারকের একজন বললেন- ‘আমরা নায়ক-নায়িকা বেশ পেয়েছি কিন্তু ক্যারেক্টার আর্টিস্টের ভীষণ অভাব। আনু আপা (অভিনেত্রী আনোয়ারা) একা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছেন না। আপনাকে আমরা পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রি আরেকজন মা পেল।’ সুযোগ এলো নিজেকে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রে প্রমাণ করার। সেই থেকে শুরু তার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পথচলা।

বর্তমানে নাটক ও টেলিফিল্মের গল্প রচনা করেই সময় পার করছেন এক সময়ের তুমুল ব্যস্ত এই অভিনেত্রী। তবে এসব নাটক ও টেলিফিল্মগুলোর নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না তিনি। তার প্রবল ইচ্ছে তার রচিত নাটক, টেলিফিল্মগুলো নির্মিত হয়ে দর্শকের সামনে আসুক। আর এজন্য তিনি যথাযথ প্রযোজক এবং নির্মাতাদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। এ কারণেই এখনই নাম কিংবা এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলতে নারাজ তিনি। খালেদা আক্তার কল্পনা জানান, ছোটবেলা থেকেই গল্প পড়ার অভ্যাস ছিল তার। চোখের সামনে যেসব ঘটনা ঘটত, সেসব ঘটনাগুলো তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করত। সেসব ঘটনাগুলোই তিনি তুলে এনেছেন নাটক-টেলিফিল্মের গল্পে। অভিনয়ের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর প্রথম যে নাটকটি তিনি রচনা করেন, সেটি প্রচার হয়নি। তবে পরবর্তীতে এটিএন বাংলায় প্রচার হয় তার রচিত ও মনোয়ার খোকন পরিচালিত ধারাবাহিক নাটক ‘আপনার চেয়ে আপন’ নাটকটি। অবশ্য তার আগে তার রচনায় মনোয়ার খোকন নির্মাণ করেন রবি চৌধুরীকে নায়ক হিসেবে নিয়ে ‘ফেরারী সুখ’ নামের একটি নাটক। এরপর আরও বহু নাটক রচনা করেছেন কল্পনা।

অভিনয় করতে করতে অনেক ভুল-ত্রুটি চোখে পড়ত। এক সময় আমার কাছে মনে হলো, কেন আমি নিজে লিখছি না। আর ছোটবেলা থেকে নিজের মনে বীজ বপন করাই ছিল লেখালেখির ব্যাপারে। পরে এক সময় লেখালেখি শুরু করলাম। একুশে টিভিতে যখন শ্রদ্ধেয় আতিকুল হক চৌধুরী ছিলেন, তখন তিনি আমাকে একদিন ডেকেছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমার লেখা সংলাপ এক কথায় অসাধারণ। তার সেই কথা আমার কাছে অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির মতোই মনে হয়েছিল। এখনো অনেক নাটক, টেলিফিল্ম লেখা আছে। আমার খুব ইচ্ছে নির্ভরশীল কোনো প্রযোজক-পরিচালকের কাছে তা তুলে দিতে। আমি চাই আমার রচিত নাটক-টেলিফিল্মগুলো দর্শকের কাছে পৌঁছাক।’

 

খালেদা আক্তার কল্পনা অভিনীত প্রথম সিনেমা মতিন রহমান পরিচালিত ‘রাধা কৃষ্ণ’। নায়ক রাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় নির্মিত ‘জিনের বাদশা’ সিনেমাতে অভিনয় করে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। নাটক লেখা ও অভিনয়ের পাশাপাশি সিনেমার গানও লিখেছেন এই শিল্পী।