'পুলিশের প্রশিক্ষণ' পাওয়া চোরের সাথে গ্রেপ্তার গুরু পুলিশও

'পুলিশের প্রশিক্ষণ' পাওয়া চোরের সাথে গ্রেপ্তার গুরু পুলিশও

ছবি : প্রতীকি

ব্যাঙ্গালোরের রেল পুলিশ চলন্ত ট্রেনে যাত্রীদের ব্যাগ চুরির ঘটনার তদন্তে নেমে এক দাগী চোরকে গ্রেপ্তার করেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে রেল পুলিশ কর্মকর্তারা পেয়েছেন চোরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য।

পুলিশ বলছে, দীর্ঘদিন ধরে চলন্ত ট্রেনে চুরি করা এই চোরকে হাতে ধরিয়ে চুরির কৌশল শিখিয়েছেন একজন গুরু। শিখিয়েছেন হাতসাফাইয়ের খুঁটিনাটি আর কীভাবে পিঠ বাঁচিয়ে সটকে পড়তে হবে।

আর রোজকার 'কাজে' নেমে চোর নাকি ‘গুরু’র পরামর্শ অনুযায়ীই চুরি করত, গুরু শিষ্যকে জানিয়ে দিতেন কোথায় যেতে যেতে হবে - আর গিয়ে কী পাওয়া যাবে।তদন্তের পর পুলিশ ‘গুরু’কেও গ্রেপ্তার করেছে।আর সেই ‘গুরু’ যেন ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ প্রবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ওই চোরের গুরু স্বয়ং একজন পুলিশ।তিনি রেল পুলিশেরই হেড কনস্টেবল।এই গ্রেপ্তারে বিস্মিত পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে এসব তথ্য।

ঘটনার শুরু যেভাবে

ব্যাঙ্গালোর রেল পুলিশের এসপি এসকে সুমনলথা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অক্টোবর মাসে চুরির শিকার একজন নারীর অভিযোগের প্রেক্ষাপটে পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করে। এরপরই এই চাঞ্চল্যকর 'চোর-পুলিশ' জুড়ির ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে।তিনি জানান, গত মাসের ২৩ তারিখ ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা একজন নারী থ্রিসুর থেকে ফিরছিলেন। ট্রেনটি বায়াপ্পানাহাল্লি স্টেশনের কাছে কিছুটা ধীরগতিতে এগোচ্ছিল।

তিনি বলেন, "তার ব্যাগ রাখা ছিল আসনের ওপরে। সেটাই একজন টেনে নিয়ে পালিয়ে যায়।"ওই নারীর দায়ের করা অভিযোগে জানানো হয় যে, তার ব্যাগে প্রায় ১০ লাখ টাকার সামগ্রী ছিল।পুলিশ তদন্তে নেমে সাবান্না নামে এক চোরকে গ্রেপ্তার করে।

“এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন থেকেই ট্রেনে চুরি ছিনতাই করে আসছিল। এর আগে ২০১২, ২০১৬ আর সর্বশেষ ২০২২ সালে সে গ্রেপ্তার হয়েছিল,” বলছিলেন মিজ সুমনলথা।সাম্প্রতিকতম অভিযোগ পাওয়ার পরে পুলিশ বিভিন্ন রেল স্টেশনে নজরদারি শুরু করে।মি. সাবান্নাকে ভোরের দিকে সন্দেহজনকভাবে স্টেশনে ঘোরাফেরা করতে দেখে আটক করে পুলিশ।এরপর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন যে ওই নারীর ব্যাগটি তিনিই চুরি করেছিলেন।

যেভাবে হদিস মিললো চোরের 'গুরুর'

'শিষ্য' সাবান্নাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার একজন গুরু আছে - যিনি তাকে রীতিমত প্রশিক্ষণ দিয়ে 'চুরিবিদ্যা' শিখিয়েছেন - কী করে হাতসাফাইয়ের কাজটি করতে হবে আর কীভাবে ধরা না পড়ে বেরিয়ে যেতে হবে।কোন ধরণের জিনিস নেওয়া উচিত আর কোনটি ফেলে দিতে হবে - শিখন তালিকায় ছিল তাও।

সাথে যেন যেন বোনাস হিসেবে ছিল - 'শিষ্য'কে হালনাগাদ তথ্য দিয়ে সহায়তা করা, যেমন কোন ট্রেনে কে ঘুমোচ্ছে, কার ব্যাগ চুরি করা যেতে পারে ইত্যাদি।আর এইসব তথ্য নিখুঁতভাবে দিতে পারেন 'গুরু', কারণ তার কাজই হল চলন্ত ট্রেনে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের ওপরে নজর রাখা।পেশায় তিনি রেল পুলিশের হেড কনস্টেবল!

চোর 'শিষ্য' সাবান্নার স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে এরপর ধরা পড়েন ওই হেড কনস্টেবল সিদ্দারামা রেড্ডি।আর কাজের শেষে দুজনে ভাগাভাগি করে নিতেন চুরি থেকে পাওয়া গয়না বা টাকা পয়সা।রেল পুলিশের এসপি মিজ সুমনলথা বলছেন, “গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ওই হেড কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়েছে।“

কীভাবে সাহায্য করতেন 'গুরু'?

মিজ সুমনলথা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "চলন্ত ট্রেনে প্রহরার দায়িত্বে থাকার ফলে মি. রেড্ডি খেয়াল করতেন যে কোন যাত্রী ঘুমোচ্ছেন, বা কে অসতর্কভাবে ব্যাগ রেখেছেন কোলে বা পায়ের নিচে কিংবা মাথার ওপরে ইত্যাদি।সুযোগ বুঝে সে খবর তিনি দিয়ে দিতেন মি. সাবান্নাকে। আর মূল কাজটা হাসিল করতেন সাবান্না।"জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, কাজের পদ্ধতি এবং চুরির মালামাল ভাগাভাগিতেও তারা ছিল অত্যন্ত সতর্ক।

এরা ব্যাগ চুরি করে কেবল টাকাপয়সা, গয়না, কাপড় জামা এসবই নিত আর নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত।কিন্তু এসপি সুমনলথা জানাচ্ছিলেন, এই চোরের দল মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ বা কোনও ধরনের বৈদ্যুতিক গ্যাজেট এরা নিজেদের কাছে রাখতো না।কারণ তাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, ফলে এসব জিনিস যদি চুরি করে আনা ব্যাগে চলেও আসত, তাহলেও নিজেরা সেসবের ভাগাভাগিতে যেত না তারা।

মোবাইল, ল্যাপটপ ফেলে দিত

পুলিশে কাজ করার সূত্রে মি. রেড্ডি ভাল করেই জানতেন যে বৈদ্যুতিক যন্ত্র খুব সহজেই ট্র্যাক করে ফেলা যায়।তাই সেসব না রেখে ফেলে দিতেন গুরু-শিষ্যের দল।এসপি সুমনলথা বলেছেন, "চলন্ত ট্রেনে ব্যাগ ছিনতাই করার সময়ে তো আর ব্যাগে কী আছে, তা জানতে পারতো না তারা, খুঁজে দেখার সুযোগও নেই।ফলে ছিনতাই করার পরে কোন ব্যাগে যদি কোনও ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র পেত, সেগুলো ঝোপ-জঙ্গলে ফেলে দিত চোরের দল, যাতে এদের ট্র্যাক না করা যায়।

মিজ সুমনলথা জানাচ্ছিলেন, "এই বুদ্ধিটা মি. রেড্ডিই দিয়েছিলেন তার শিষ্যকে।"ছিনতাইয়ের শেষে টাকা পয়সা, গয়নাগাটি সব দুজনে ভাগ করে নিতেন গুরু-শিষ্য।লাভের ভাগ বরাবর যেমন ছিল, এবার যেন ফলভোগের ভাগও সমান সমান হয়েছে গুরু-শিষ্যের।যে শ্রীঘরে এতদিন চোর ধরে এনে পুড়তেন হেড কনস্টেবল মি. রেড্ডি, এখন তার শিষ্যের সঙ্গে সেই গারদের ভেতরেই ঢুকতে হয়েছে তাকে।

সূত্র : বিবিসি