গাজায় বোমা হামলা বন্ধ না হলে আঞ্চলিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি হেজবুল্লাহর

গাজায় বোমা হামলা বন্ধ না হলে আঞ্চলিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি হেজবুল্লাহর

হেজবুল্লাহর উপপ্রধান শেখ নাঈম কাসেম

গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ না হলে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর সেকেন্ড ইন কমান্ড শেখ নাঈম কাসেম।তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এই অঞ্চলে অত্যন্ত গুরুতর ও ভীষণ বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এবং এর পরিণতি কেউ আটকাতে পারবে না।’গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে সম্প্রতি জানানো হয়, সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরকম একটা সময়েই বৈরুতে একটি সাক্ষাৎকারে হেজবুল্লাহর উপপ্রধান ওই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

গত ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলায় ১,৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়, যাঁদের মধ্যে ১,০০০ বেসামরিক নাগরিক ছিলেন।হামাসের ওই হামলার জবাবেই ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালায়।হেজবুল্লাহর ওই নেতা বলেন, “বিপদটা সত্যিই আসতে চলেছে। কারণ ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বাড়াচ্ছে এবং বেশি সংখ্যায় নারী ও শিশুদের হত্যা করছে।

তার কথায়, "এই অঞ্চলে আরও বিপদ ডেকে না এনে কি এই পরিস্থিতি চলতে পারে? আমার মনে হয় না।"তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েলের হামলা বাড়লে এই অঞ্চলের যুদ্ধের ঝুঁকিও বাড়বে।“প্রতি ক্ষেত্রেই একটি করে প্রতিক্রিয়া হবে," মন্তব্য তার। 'আল্লাহ্-র দল’ হেজবুল্লাহর হাতে অনেক বিকল্প আছে বলে তিনি জানান।

প্রত্যেক বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জবাব দেবে হেজবুল্লাহ

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব লীগ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত শিয়া ইসলামী গোষ্ঠীটি লেবাননের বৃহত্তম রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি।

গাজায় যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এখনও পর্যন্ত তারা শুধুমাত্র হুঁশিয়ারির মাত্রাই বাড়িয়েছে আর সতর্কভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।রবিবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি হামলায় এক নারী ও তিন শিশুর মৃত্যুর পর হেজবুল্লাহ প্রথমবার গ্রাড রকেট ব্যবহার করে যাতে এক ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়।

হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ হুমকি দিয়ে বলেছেন, লেবাননে প্রত্যেক বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জবাব সীমান্তের ওপারেও দেওয়া হবে। তবে এখনো তিনি ইসরায়েলকে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দেননি।"সমস্ত বিকল্প পথই খোলা রয়েছে," এ কথায় জোর দিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠীটি মূলত সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের মধ্যেই নিজেদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ রেখেছে।

তাদের ৬০ জনেরও বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাদের জায়গা নেওয়ার মতো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হেজবুল্লাহ-র আরও বহু সমর্থক আছে।বৈরুতে এমন এক যোদ্ধাকে এই সপ্তাহে কবর দেওয়া হয়েছে, যাঁর পরিবারের সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে হেজবুল্লাহর হয়ে লড়াই করে এসেছে। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর পরিবারের পঞ্চম সদস্য যিনি ওই গোষ্ঠীর হয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

হেজবুল্লাহর বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার

সাক্ষাত্কারের সময় সংগঠনের উপপ্রধান হেজবুল্লাহকে একটি প্রতিরক্ষামূলক সংগঠন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন – যদিও তারা ইসরায়েলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ২০০৬ সালে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালিয়ে দুজন ইসরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ করে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল।হেজবুল্লাহর ওই নেতা দাবি করেছেন, ইসরায়েল “গাজার বিরুদ্ধে জঘন্য আগ্রাসনের খেলায় মেতেছে।”

বিবিসি যখন উল্লেখ করে যে হামাসই সাতই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল, তার উত্তরে তিনি বলেন ফিলিস্তিনি জমির অধিগ্রহণ রুখতে ওই আক্রমণ অনিবার্য ছিল।হেজবুল্লাহর ওই নেতা এরকম একটা ভিত্তিহীন দাবিও করেন যে, হামাস নয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীই ইসরায়েলের অনেক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে।হামাসের সশস্ত্র বাহিনীর হেলমেট-ক্যামেরায় ধরা পড়া হত্যালীলার ছবির কথা জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।

তিনি বলেন, “গাজার অভ্যন্তরে ইসরাইল কী করেছে সেটা আমরা কেন দেখছি না। তারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করে বাড়িঘর ধ্বংস করছে।"তিনি হামাসের হামলাকে "ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ" বলে চিহ্নিত করেছেন এবং অস্বীকার করেছেন যে তাদের পরিকল্পনার ফলাফল ঠিক উল্টো হয়েছে।কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে ১০ হাজার গাজাবাসী নিহত হয়েছেন, তাদের বিষয়টা?

জবাবে তিনি বলেন, "ইসরায়েলের গণহত্যা ফিলিস্তিনিদের আরও বেশি করে মাটি আঁকড়ে থাকতে উদ্বুদ্ধ করছে ।”তিনি স্বীকার করেছেন যে ইরান হেজবুল্লাহকে "সমর্থন করে এবং অর্থের জোগান দেয়", তবে এটাও দাবি করেন যে তারা আদেশ দেয় না।

অন্য দিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেহরানই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবে এবং ঠিক করবে যে সর্বাত্মক যুদ্ধে আদৌ অংশ নেবে কি না।ইসরায়েলি বাহিনীকে যদি দ্বিতীয় একটা যুদ্ধক্ষেত্রে হেজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াই করতে হয়, তাহলে তাদের এমন এক শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে যাদের কাছে অন্য বহু দেশের থেকেও বেশি অস্ত্র মজুত রয়েছে।

এদিক থেকে হামাসকেও পিছনে ফেলে দিতে পারে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীটি, যাদের কাছে আনুমানিক দেড় লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে।বৈরুত-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরামর্শদাতা নিকোলাস ব্লানফোর্ডের মতে, বিশেষ বাহিনী, যোদ্ধা এবং রিজার্ভ সহ ৬০হাজার যোদ্ধা রয়েছে তাদের।মি ব্লানফোর্ড বিগত কয়েক দশক ধরে হেজবুল্লাহর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।

যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ বাঁধে

এই গোষ্ঠীটি ২০০৬ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে দেশটিকে একরকম অচল করে দেওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছে, যদিও এতে লেবাননের মানুষই বেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন।হেজবুল্লাহর এক হাজারেরও বেশি সদস্য নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। শুধু তাই নয় হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ইসরায়েলের ১২১ জন সৈন্য ও ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।

এর পর থেকেই লেবানন একের পর এক সমস্যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। যেমন, ২০২০ সালে বৈরুত বন্দরে বিধ্বংসী বিস্ফোরণ, অর্থনীতির পতন এবং রাজনৈতিক ডামাডোল।এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে খুব কম লোকেরই এখনও যুদ্ধ করার জন্য আগ্রহ রয়েছে।অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে হেজবুল্লাহর আন্তঃসীমান্ত হামলা এই দেশকে এমন একটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে যা তারা বহন করতে পারবে না।

শেখ কাসেম অবশ্য তা নিয়ে ভাবিত নন। তিনি বলেন, “যুদ্ধকে ভয় পাওয়াটা যেকোনোও লেবাননবাসীর অধিকার। এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ কেউ পছন্দ করে না। ইসরায়েলকে আগ্রাসন বন্ধ করতে বলুন, যাতে যুদ্ধ আর ছড়ায়।”হেজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু না হলেও উত্তেজনা বৃদ্ধি হলে তার বিভিন্ন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

আর যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তা শুধুই ধ্বংস ডেকে আনবে বলে মেন করেন মি. ব্লানফোর্ড।তিনি বিবিসিকে বলেন, "সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে গাজায় এখন যা চলছে, সেটাকে একটা খুবই সামান্য ঘটনা বলে মনে হবে।

"সংঘাতের সময় পুরো ইসরায়েলে লকডাউনে থাকবে। সেখানকার বেশির ভাগ মানুষকে বোমা-প্রতিরোধী কেন্দ্রে থাকতে হবে। বেসামরিক বিমান চলাচল আর জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। হেজবুল্লাহর বড় বড় গাইডেড মিসাইলগুলি দেশের সীমানা অতিক্রম করে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।"লেবাননের বিষয়ে তিনি বলেন, ইসরায়েল সেটাকে একটা 'গাড়ি পার্কিং'-এর জায়গার মতো বানিয়ে দেবে।

বর্তমানে হেজবুল্লাহ, ইসরায়েল ও ইরান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে, হিসাব কষছে সবাই, পুরনো শত্রুরা নতুন পরিস্থিতি মাপছে।এর অর্থ এটা নয় যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘটবে না, হতে পারে সেটা হিসাবের ভুলে অথবা হিসাব কষেই।এই রক্তে ভেজা অঞ্চলে এ যেন একটি বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়। হামাসের সাতই অক্টোবরের হামলার পরে বেদনা, মৃত্যু এবং ধ্বংসই শুধু সত্য বলে মনে হয়।

সূত্র : বিবিসি