ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিক; উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিক; উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন

ফাইল ছবি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠানের নাম নয়; এটি মুসলমানদের একটি সংগ্রামী ইতিহাসের নাম। ১৯৭৯ সালে বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বাংলায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে ইসলামী শিক্ষার এক উচ্চ পাদপীঠ। ঐশী জ্ঞানের সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে বিশেষ এক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এদেশের প্রতিটি নাগরিককে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু আজ সে উদ্দেশ্য হতে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। তাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য  বাস্তবায়ন আশু প্রয়োজন।

ইতিহাস

১৯১২ সালে আবাসিক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীর পর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মওলানা আকরম খাঁ কমিশনসহ গঠিত প্রায় সকল কমিশনেই একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ ছিল। এই সুপারিশ বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া মিটিং-মিছিল সংগ্রাম করার পরেও পৌনে এক শতাব্দীর অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে আজ না চাইতেই সংসদে একসাথে হাফডজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অধ্যাদেশ পাস হয়।

১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ার শন্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ১৭৫ একর জমিতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে এদেশের মুসলমানদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়টির রূপরেখা বৈশিষ্ট্য কি হবে কি হওয়া উচিত সেটা নাম দেখেই বুঝা যায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো এদেশে  ত্রিশোর্ধ্ব বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়  চরিত্র বৈশিষ্ট্যৈর দিক থেকে আপন স্বকীয়তায় ভাস্বর থাকলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আদল রূপ আর আজ তেমন নেই।

বর্তমান

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অনুষদ ৮ টি। বিভাগ ৩৬টি। হল ৮টি(ছাত্রী হল ৩টি) ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৭,৬৮৯। এম ফিল গবেষণারত ২১৯ জন। পিএইচডি গবেষণারত ২৯০ জন। এমফিল ডিগ্রীপ্রাপ্ত ৭২৪ জন। পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত ৫৫৩ জন। ২৫ জন মহিলা শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা ৩৯৩। কর্মকর্তা ৪৬৮ জন। কর্মচারীর সংখ্যা ৩২৫ জন। বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম প্রোভিসি অধ্যাপক ড. মোঃ মাহবুবুর রহমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোঃ আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যাবলী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী(১৮৭৫-১৯৫০) ১৯৬৩ সালের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইনের ইসলামিক এরাবিক ইউনিভার্সিটি কমিশন এবং ড.এম.এ.বারী কমিশনসহ বিভিন্ন কমিশন কমিটি যেসব উদ্দেশ্যাবলীর প্রস্তাব করেন তা নিম্নরূপ -

১. আধুনিক শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষার একত্রিকরণ।

২. নতুন আঙ্গিকে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও পুনর্বিন্যস্ত করণ।

৩. ইসলামী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব নিশ্চিতকরণ ও ইসলামী গবেষণায় সুবিধা প্রদান।

৪. কলা ও বিজ্ঞানের বিবিধ শাখার সাথে ইসলামী শিক্ষার সংযোগ ও সমন্বয় সাধন।

৫. ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা।

৬. দ্বিমুখী শিক্ষা পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটিয়ে মুসলিম সমাজে ঐক্য স্থাপন করা।

৭. ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে তথাকথিত অনৈসলামিক ও ইসলামী শিক্ষার বিরোধ অবসান করা।

৮. মুসলিম মনীষী সৃষ্টির মাধ্যমে গোটা পরিবেশ ইসলামী শিক্ষার পুনর্জাগরণ করা।

৯. ঐশী ও জাগতিক জ্ঞানের বিবিধ ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে দেশে একটি সুসংহত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন।

১০. স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী শিক্ষার অন্যান্য শিক্ষণ শাখাসমূহে এবং তুলনামূলক আইন বিজ্ঞান ও এরূপ শিক্ষণ শাখাসমূহে শিক্ষাচর্চার ব্যবস্থা করা।

১১. গবেষণা, উচ্চতর গবেষণাসহ প্রশিক্ষণের জন্য ও জ্ঞানের অগ্রসরতা ও বিকীরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১২. সরকারী মাদরাসা সমূহে অনুসৃত পদ্ধতি থেকে অগ্রসর পদ্ধতিতে মুসলমান ছাত্রদের কুরআন, হাদীস ও ইসলামের মূল তত্ত্ব জ্ঞান প্রদান এবং অমুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্যে সময়োপযোগী ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও প্রচারক তৈরী করণ।

১৩. মুসলমানদের কাছে ইসলামকে যুক্তিতর্ক ও শাস্ত্রগত তথ্যের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাতির ইতিহাস ধর্মতত্ত্ব ও তাদের মূল ধর্মীয়ভাষা শিক্ষণ।

১৪. মাদ্রাসা শিক্ষার ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যুগের চাহিদা অনুযায়ী  চাকুরী লাভ এবং রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে সেভাবে  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাঠ্যসূচীভুক্ত করা ।

১৫. ইসলামী শিক্ষা এবং মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শী  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমন ছাত্র তৈরি করা যারা কর্ম জীবনে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল জনগণের আশা আকাঙ্খা পুরণ।

প্রস্তাবনা :

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ১৫ বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তার স্ব অবস্থানে আছে না ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে । ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মূল ধারায় পরিচালিত করতে এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদানে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী মহলের কাছে প্রস্তাব রাখতে চাই।

এক. কলা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে কলা ও বিজ্ঞানের সাথে ইসলামী শিক্ষাকে সমান্তরালে রাখা।

দুই. কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ক ২৯টিই বিভাগের কোনটিতেই ইসলামী শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট মৌলিক/ মেজর কোন বিষয় নেই। সে বিভাগগুলোর প্রতিটিতে ইসলামী শিক্ষার মৌলিক অন্তত পাঁচটি করে কোর্স সংযুক্তকরণ।

তিন.কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ক ২৯টিই বিভাগের কোন  কোর্সের সাথে ইসলামের ন্যূনতম  সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই প্রতিটি বিভাগ সংশ্লিষ্ট কোর্সকে ইসলামিকরণ করা।

১.কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে প্রস্তাবিত সম্ভাব্য কোর্সগুলো হল-

ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ইসলামে সমাজ ব্যবস্থা, ইসলামে অর্থ ব্যবস্থা, ইসলামে ব্যক্তি দর্শন, ইসলামে পরিবার ও পারিবারিক দর্শন, ইসলামে সমাজ দর্শন, ইসলামে রাষ্ট্র দর্শন, ইসলামে পররাষ্ট্র নীতি, আল-কুরআনে সমর দর্শন, আল-কুরআনে শিক্ষা দর্শন, আল-কুরআনে গবেষণা পদ্ধতি বিজ্ঞান, আল-কুরআনে প্রতœতত্ত্ব, আলকুরআনে নীতি দর্শন, আল-কুরআনে ইতিহাস দর্শন, ইত্যাদি।

২.বাণিজ্য অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে প্রস্তাবিত কোর্সগুলো হল- ইসলামে বণ্টন ব্যবস্থা, ইসলামে ব্যংকিং ব্যবস্থা, ইসলামে কর ও ট্যাক্স ব্যবস্থা, ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য, আল-কুরআনে বাণিজ্যনীতি, আল-কুরআনে ধনবিজ্ঞান ইত্যাদি। 

৩.আইন অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে প্রস্তাবিত কোর্সগুলো হল- ইসলামে ভূমি ব্যবস্থা, ইসলামে উত্তরাধিকার আইন, ইসলামে ব্যক্তি আইন, ইসলামে পারিবারিক আইন, ইসলামে সামাজিক আইন, ইত্যাদি।

বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে নিম্নে বর্ণিত শিরোনামে কোর্সগুলো থাকতে পারে-

আল-কুরআনে জীববিজ্ঞান, আল-কুরআনে উদ্ভিদবিজ্ঞান, আল-কুরআনে রসায়ন বিজ্ঞান, আল-কুরআনে পদার্থ বিজ্ঞান ইত্যাদি। এসব মৌলিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা দিয়ে এক একটি কোর্স প্রণয়ন করা যেতে পারে। যেমন-

আল-কুরআন কীটপতঙ্গ, আল-কুরআনে  খেচর, আল-কুরআনে ভূবিজ্ঞান, আল-কুরআনে ভূত্ব বিজ্ঞান,  আল-কুরআনে মহাকাশ বিজ্ঞান, আল-কুরআনে সৌরবিজ্ঞান,  আল-কুরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, আল-কুরআনে পরিবেশ বিজ্ঞান, আল-কুরআনে আবহাওয়া বিজ্ঞান, আল-কুরআনে চিকিৎসা বিজ্ঞান, আল-কুরআনে কম্পিউটার বিজ্ঞান, আল-কুরআনে সংখ্যা তত্ত্ব, আল-কুরআনে সময় তত্ত্ব, আল-কুরআনে পুষ্টি বিজ্ঞান, আল-কুরআনে খাদ্য বিজ্ঞান,  আল-কুরআনে প্রযুক্তি বিজ্ঞান, আল-কুরআনে জলযান, আল-কুরআনে স্থলযান, আল-কুরআনে আকাশযান, আল-কুরআনে জড় বিজ্ঞান, আল-কুরআনে প্রকৌশল বিজ্ঞান, আল-কুরআনে চর্মপ্রযুক্তি, আল-কুরআনে স্থাপত্য বিদ্যা, আল-কুরআনে খণিজ বিজ্ঞান, আল-কুরআনে কৃষি বিজ্ঞান, আল-কুরআনে হাজবেন্ডারী,  আল-কুরআনে সামুদ্রিক বিজ্ঞান, আল-কুরআনে মৎস বিজ্ঞান, আল-কুরআনে সৃষ্টিতত্ত্ব, আল-কুরআনে নৃবিজ্ঞান, আল-কুরআনে ধাত্রী বিদ্যা, আল-কুরআনে শরীর তত্ত্ব, আল-কুরআনে ভ্রূণ তত্ত্ব, আল-কুরআনে মনোবিজ্ঞান, আল-কুরআনে কীটতত্ত্ব, কুরআনের চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে তার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রাখতে চাইলে আমার প্রস্তাবিত বিষয় এবং তার সঙ্গে বিশ্বের ইসলামী প-িতদের আরো অতিরিক্ত কিছু বিষয়ে সংযোগ করা যেতে পারে। তাহলেই কেবল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সফল হবে অন্যথায় নয়।

লেখক: প্রফেসর ড. আ.ব.ম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়