মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এক সপ্তাহে যা যা ঘটলো

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এক সপ্তাহে যা যা ঘটলো

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এক সপ্তাহে যা যা ঘটলো

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গত সপ্তাহে নতুন সব সহিংসতা দেখা গিয়েছে, যা অস্থির এই অঞ্চলে সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।এক নজরে একটু দেখে নেয়া যাক কী কী ঘটলো এবং সামনে এসব সংঘাত কোন দিকে মোড় নিতে পারে?

ইরান-পাকিস্তান

মঙ্গলবার ইরান একেবারে আচমকা পাকিস্তানের ভেতরে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালায়।ইরান বলছে তারা এই হামলাটি করেছে ইরানের একটি সুন্নি মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ আল আদলের ঘাঁটি লক্ষ্য করে, যারা ইরানের ভেতরে হামলা চালিয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয় হামলায় দুই শিশু মারা গিয়েছে এবং তারা দ্রুতই পাল্টা আক্রমণে যায়।

পাকিস্তান এবার ইরান সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি “জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানা’ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। ইরান বলেছে হামলায় তিন নারী, দুই পুরুষ ও চার শিশু নিহত হয়।এমন পাল্টাপাল্টি হামলা আগে থেকেই নানামুখী সঙ্কটে থাকা এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।যদিও এমন ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়ার এই ঘটনাটি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যের মূল লড়াইয়ের কেন্দ্র ইসরায়েল-গাজা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু সীমান্তে এখন যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, আরও নতুন কোন ঘটনা এক্ষেত্রে সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে, যেমন জইশ আল আদল যদি ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ইয়েমেন ও লোহিত সাগর

বিশ্বের বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পথ লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজে হুথিদের হামলার পর এই সপ্তাহে ইয়েমেনের হুথি জাইদি শিয়া গোষ্ঠীর উপর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী বেশ কয়েকদফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।ইরান সমর্থিত হুথিরা গাজায় যুদ্ধ শুরু হবার প্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে লোহিত সাগরে হামলা চালানো শুরু করে। তারা ঘোষণা দেয় যতদিন ইসরায়েল গাজায় অভিযান চালাবে ততদিন তারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে “ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কিত” জাহাজগুলোতে হামলা চালাবে।

ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক সাগরে চলমান সকল বাণিজ্যিক জাহাজই এতে হুমকিতে পড়ে যায়, যা পশ্চিমা শক্তিগুলো মেনে নিতে পারেনি।যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য, তাদের মিত্রদের নিয়ে হুথিদের থামাতে গত সপ্তাহে তাদের উপর বিমান হামলা চালায়, কিন্তু হুথিরা এখনো হুমকি হিসেবেই থেকে গিয়েছে।

গত সোমবার হুথিরা এডেন উপসাগরে একটি মার্কিন জাহাজে আঘাত করতে সমর্থ হয়, যেটা তাদের হামলা শুরুর পর আমেরিকার কোন জাহাজে হামলায় প্রথম সাফল্য হিসেবে মনে করা হয়।বুধবার এডেন উপসাগরে আরেকটি হামলায় সফল হয় তারা। হুথিরা এরকম হামলা চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে – যা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলার সম্ভাবনাও তৈরি করছে, এখন শুধু দেখার বিষয় ইরানও এতে যুক্ত হওয়ার দরকার মনে করে কি-না।

ইসরায়েল-হেজবুল্লাহ-ইরান

দুই চিরশত্রু ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ছায়াযুদ্ধ তীব্র রুপ নেয়, যখন সোমবার ইরান ইরাকের আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চল ইরবিলে, ইসরায়েলে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তর লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, যাতে চারজন মারা যায়।

কিন্তু ইরাক – যারা ইরানের মিত্র হিসেবে খ্যাত এবং ইসরায়েল বিরোধী তারা এই হামলার নিন্দা করে এবং সেখানে মোসাদের কোনরকম অস্তিত্ব অস্বীকার করে।ইরান বলছে তাদের এই হামলা সম্প্রতি ইসরায়েল সিরিয়ায় যে এক উচ্চপদস্থ ইরানিয়ান কমান্ডার এবং লেবাননে আরও দুজন ইরান সমর্থিত শীর্ষ জঙ্গিকে হত্যা করেছে – যাদের একজন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর কমান্ডার এবং আরেকজন ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাসের উপ নেতা, সেটার জবাব।

ইসরায়েল-লেবানন সীমান্ত এই মূহুর্তে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা, যেখানে ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহ – যারা ইরানের অর্থে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত – তারা ৭ই অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিয়মিতই সেখানে গুলি ও ক্ষেপণাস্ত্র বিনিমিয় করছে।বুধবার ইসরায়েলের মিলিটারি চিফ অফ স্টাফ বলেন, “সামনের মাসগুলোতে উত্তরে যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা অতীতের থেকে এখন অনেক বেশি।”

ইরান-ইসলামিক স্টেট গ্রুপ

ইরান যখন ইরাকে হামলা করেছে, সেই একই সময় তারা সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিতে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি অঞ্চলে মিসাইল ছোঁড়ে, যা তারা বলছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঘাঁটি লক্ষ্য করে এই হামলা করা হয়, আর এটি গত ৩রা জানুয়ারি ইরানে এক আত্মঘাতী হামলায় আইএস যে ৯৪ জনকে হত্যা করে সেটার জবাব।আইএস হল একটা সুন্নী জিহাদি গোষ্ঠী, যারা শিয়াদের মুসলিম ধর্মবিরোধী বলে মনে করে, আর এই অঞ্চলে ইরান হল শিয়াশাসিত শক্তিশালী রাষ্ট্র।ইরান সিরিয়া সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, সরাসরি সেখানকার বিদ্রোহীদের অঞ্চলে জঙ্গিদের উপর হামলা একেবারেই বিরল এবং এটা সংশ্লিষ্টদের একটা বার্তা যে ইরান এখন প্রয়োজনে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত।

ইসরায়েল-সিরিয়া-ইরান

সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে , শনিবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি বিমান হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছে । যাদের মধ্যে পাঁচজন ইরানের অভিজাত ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের উচ্চপদস্থ সদস্য।সিরিয়া এবং ইরান এ হামলায় ইসরায়েলকে দায়ী করে এবং ইরান এর প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেয়।

এ সপ্তাহের শুরুর দিকে দামেস্কের আশেপাশে এমন আরও হামলার ঘটনা ঘটে। ইসরায়েল এ নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করেনি, তবে এর আগে স্বীকার করেছে যে সিরিয়ায় শত শত বিমান অভিযান চালানো হয়েছে যার মধ্যে ইরানের সাথে যুক্ত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা হয়েছে।সিরিয়ান আকাশ প্রতিরক্ষা থেকে এরকম যুদ্ধ বিমানকে বাধা দেয়া – যা এখনো ঘটেনি – অথবা মারাত্মক পাল্টা হামলা যুদ্ধবেষ্টিত এই অঞ্চলে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।

ইসরায়েল – গাজা

গাজায় ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে তীব্র লড়াই চলমান এবং এই যুদ্ধ এরইমধ্যে ১৫তম সপ্তাহে এসে পড়েছে।গত রোববার থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৭১৩ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে। আর হামাস নিয়ন্ত্রিত সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে ৭ই অক্টোবরের পর থেকে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার।

অন্যদিকে ইসরায়েলের দিক থেকে এই সময়ে তাদের আটজন সেনাসদস্য মারা যায়, যা সবমিলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের মৃতের সংখ্যা নিয়ে যায় ১৮৮-তে।ইসরায়েল গত সপ্তাহে দক্ষিণের শহর খান ইউনিসে তাদের সর্বাত্মক অভিযানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায় তাদের সৈন্যরা যুদ্ধ শুরুর পর এই মূহুর্তে দক্ষিণের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে।

আর এ সপ্তাহে ইসরায়েলি টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন এই যুদ্ধ ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলতে পারে।

এছাড়া সোমবার ইসরায়েল এক চলন্ত গাড়ি ও ছুড়ি হামলার শিকার হয়, যে অভিযোগে দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে পুলিশ দুজন সন্দেহভাজন ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করে।গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলে এরকম হামলার ঘটনা এটাই প্রথম, যা ৭ই অক্টোবরের হামলার স্মৃতি এখনো মুছতে না পারা ইসরায়েলিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।গাজায় যুদ্ধের পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে।চিকিৎসকরা বলছেন, বুধবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় সেখানে ৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। ইসরায়েলের দাবি তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন তখন হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থা

এই সপ্তাহে এক দেশ দ্বারা আরেক দেশে হামলার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য কিছু অঞ্চলেও ঘটেছে।তুরস্ক সোমবার উত্তর ইরাকে কুর্দি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এবং উত্তর সিরিয়ায় মার্কিন সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া জোটের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।সাম্প্রতিক হামলাগুলো তুরস্ক এবং সশস্ত্র কুর্দি গোষ্ঠীর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অংশ। তুরস্কে একটা বিরাট অংশ কুর্দিশ সংখ্যালঘুর বসবাস এবং তুরস্ক তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করে।এগুলোর মধ্যে একটা হামলা প্রায় তিন হাজারে বেশি আইএস বন্দি থাকা কারাগারে আঘাত করে বলে জানা যায়।

একই সপ্তাহে সিরিয়ার সীমান্তে এক বিরল বিমান হামলা চালিয়েছে জর্ডান। যাতে শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে মাদক চোরাকারবারিদের টার্গেট করা হয় এই হামলায়। সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের দেশে এবং আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতে অ্যাম্ফিটামিন ক্যাপ্টাগন পাচারের অভিযোগ আছে জর্ডানের।আর ইরাকে, মার্কিন সামরিক বাহিনী বলেছে যে ইরান-সমর্থিত জঙ্গিদের দ্বারা আল আসাদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ছোড়ার পর তাদের বেশ কয়েকজন সদস্য এখন "মস্তিষ্কে আঘাতজনিত ট্রমার" সেবা নিচ্ছে। অন্তত একজন ইরাকি সেনা সদস্য আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড।

সূত্র : বিবিসি