ধর্ষণের অভিযোগে উত্তপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের অভিযোগে উত্তপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের অভিযোগে উত্তপ্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছে শিক্ষার্থীরা।

শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের পাশের জঙ্গলে এ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।এরই মধ্যে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী ছয়জনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি গণধর্ষণের মামলা করার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্তসহ চারজনকে গ্রেফতার করে।প্রধান অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তবে অভিযোগ ওঠার পর তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে শাখা ছাত্রলীগ জানিয়েছে।

যা ঘটেছে
ভুক্তভোগী নারীর স্বামী বলেন, ‘তাদের বাড়ি আশুলিয়ায়। পূর্ব পরিচিত ব্যক্তি মামুন তার বাসায় বেশ কিছুদিন ছিলেন। শনিবার রাতে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মামুন তাকে যেতে বলেন’।

‘সেখানে যাওয়ার পর মোস্তাফিজ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে বাসায় থাকা মামুনের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসার জন্য আমার স্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়। কারণ মামুন ক্যাম্পাসে মোস্তাফিজের কাছে কিছু দিন থাকবেন’।পরে তার স্ত্রী কাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসে এলে সেগুলো মীর মোশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে রেখে আসতে যায় মামুন। সেখানেই আটকে রাখা হয় ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে।

‘ওই রুম থেকে ফিরে এসে মামুন ও মোস্তাফিজ ভুক্তভোগী নারীকে বলে তার স্বামী অন্য দরজা দিয়ে আসবেন। তাদের সাথে সেখানে যেতে। পরে তাকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে’ বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী।রাতেই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেন, প্রশাসন জবাব চাই’; ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’; ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি দাবিতে স্লোগান দেয়।

এদিকে, রোববার দুপুরেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রেজিস্টার্ড ভবনের সামনে আবারো শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে বসে। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও মামলা করতে হবে।বহিরাগত শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে ক্যাম্পাস থেকে বের করার দাবিও জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সংহতি প্রকাশ করে।এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ও শাস্তি দাবি করে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন,‘আগে ঘটে যাওয়া নিপীড়ণের ঘটনার শাস্তি হলে এমন ঘটনা ঘটতো না। রাষ্ট্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যাতে জড়িতদের কঠোর শাস্তি হয় সে দাবি জানানো হয়েছে।’এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসানের দাবি, ‘এ ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। বছর দেড়েক আগে সে পাস করে গিয়েছে। কিন্তু সে হলেই থাকতো।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণের মতো ঘটনা এবারই নতুন নয়। প্রায় ২ হাজার সাবেক শিক্ষার্থীরা এখনো হলগুলোতে অবস্থান করছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ধরনের সমস্যা রোধ করতে পারছে না? এমন প্রশ্নে প্রক্টর জানান,‘ক্যাম্পাসটা অনেক বড়। প্রত্যেকটা স্পটে প্রশাসনের থাকা সম্ভব না। বর্তমান শিক্ষার্থীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস পেতো না।’

‘সাবেক শিক্ষার্থীরা এখনো হলে রয়ে গেছে। ফলে এ ধরনের সংকট তৈরি হয়। তাদের বের করার জন্য ইতোমধ্যেই প্রক্টরিয়াল টিম তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। যাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে আর কেউ সাহস না পায়। এ ঘটনা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনভাবেই প্রত্যাশিত ঘটনা নয় বলেও তিনি জানান।হাসান বলেন,‘বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠক রয়েছে। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’

অভিযুক্তসহ চারজন গ্রেফতার
ঢাকা জেলা উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: আব্দুল্লাহিল কাফি জানিয়েছেন, ‘এই ঘটনার প্রধান আসামি মোস্তাফিজসহ চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পলাতক দু’জনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’

মামলার প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত যুবক মামুন।

আবদুল্লাহিল কাফি জানিয়েছেন, এই ঘটনা জানার পর সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানার পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে। অভিযুক্তদের পালিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করার অভিযোগে প্রথমে ক্যাম্পাস থেকে তিনজনকে আটক করা হয়।রোববার ভোরে সাভার থেকে মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়। পালিয়ে থাকা আরো দু’জনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের সাবেক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। এ ঘটনায় ওই নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।

গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-চেষ্টার অভিযোগ আনে ওই বিভাগেরই এক ছাত্রী। লিখিতভাবে ভিসির কাছে ওই অধ্যাপক সম্পর্কে যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ-চেষ্টার অভিযোগ করেছিলো ওই ছাত্রী।বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের হাতে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

এর প্রতিবাদে সে সময় বড় রকমের আন্দোলন হয়েছিল ক্যাম্পাসে। প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছিল ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা।

এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে ওই সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি তৈরির ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠে।এ অবস্থায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি এক রিট আবেদন করে। পরের বছর ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মস্থলে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল।

সূত্র : বিবিসি