বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন?

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন?

ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্ত এলাকা

বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্ত এলাকায় গত কয়েক দিন ধরে টানা সংঘাতের পর শুক্রবার উত্তেজনা কমে এসেছে। তবে এই সংঘাতের পর মঙ্গলবার রাখাইন রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি।ফলে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমার সীমান্তের সামরিক টহল চৌকিগুলোতে এখন রয়েছে আরাকান আর্মির সদস্যরা যারা মূলত বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে এই এলাকায় খুবই সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না যাতে করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে ভুল কোন বার্তা যায়।নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর(অব:) ইমদাদুল ইসলাম মনে করেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের এই সীমান্ত সামরিকভাবে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

বৃহস্পতিবার ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত প্রাচীরে আরাকান আর্মির সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থায় সীমান্তে পাহারা দিতে দেখা গেছে। সেখানে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর কোনও উপস্থিতি চোখে পড়েনি।

মিয়ানমারের পত্রিকা ইরাবতীর সাতই ফেব্রুয়ারির এক খবরে বলা হয়েছে, মাস খানেক ধরে হামলা চালানোর পর গত ৬ই ফেব্রুয়ারি জাতিগত রাখাইন সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাজ্যটির মিনবিয়া শহরাঞ্চলে থাকা দুটি জান্তা সামরিক ইউনিটের সদরদপ্তরগুলো দখল করে নিয়েছে।একই দিনে বাংলাদেশের সাথে সীমান্তে মংডু শহরাঞ্চলের টং পিও টহল চৌকি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এছাড়া মঙ্গলবার পর্যন্ত রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও, মিনবিয়া, রামরি, আন এবং মাইবন এলাকায় সংঘর্ষ চলেছে।

কী অবস্থা সীমান্তের?

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, তমব্রু সীমান্তে পরিস্থিতি আগের তুলনায় শান্ত হয়ে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে এবং তারা তাদের বাড়ি-ঘরে ফেরত যেতে শুরু করেছে।মিয়ানমারের ভেতরে সামরিক বাহিনী আউটপোস্টগুলো আরাকান আর্মি দখলে নেয়ার পর বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে কোন ধরনের বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবি এখনো পর্যন্ত “ধৈর্য ধারণ করে সব ধরনের প্রস্তুতি তারা রেখেছে।” এ বিষয়ে তিনি আর কোন তথ্য দিতে চাননি।

সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সেনা মোতায়েনের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো হলেও সেটা অনেক বেশি নয় বলে জানা যাচ্ছে।বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে বাংলাদেশের জনসাধারণ, সম্পদ বা সার্বভৌমত্ব কোনও ভাবে যাতে হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

বিদ্রোহীরা ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা ছাড়িয়ে দক্ষিণের দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।মিয়ানমারের ভেতরে সংঘাতের জের ধরে সীমান্তবর্তী টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে ১০ই ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকবাহী সব জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এটি বন্ধ থাকবে।

সীমান্ত বন্ধ

ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্তের মিয়ানমার অংশে আরাকান আর্মি দখলে থাকার সময়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও একটি বিষয়ে তারা মোটামুটি একমত। আর তা হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদে আসলে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু পদক্ষেপ নেয়ার নেই। কারণ সংঘাতের বিষয়টি এখনো মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরেই রয়েছে।তারা বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত সংঘাতময় সীমান্ত সামরিকভাবে বন্ধ করে দেয়া।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব:) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত সামরিকভাবে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প এখন হাতে নেই।কোন বিদেশি নাগরিক বা আশ্রয় প্রার্থী বা আদিবাসীরা এসে যাতে আশ্রয় নিতে না পারে সে অর্থে বন্ধ করে দেয়া নয়, বরং সীমান্তের ভেতরে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের দখল হয়ে যাওয়া টহল চৌকি পুনরুদ্ধারে অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশের ভেতরে এক ধরণের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি। আর সেটি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রস্তুতি রাখতে হবে।তিনি বলেন, মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা পুলিশ যেমন বাংলাদেশের ভেতরে আশ্রয়ের জন্য ঢুকে পড়েছে, তেমনি আরাকান আর্মির সদস্যরাও যাতে ঢুকে পড়তে না পারে নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব:) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের তরফ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যাত্রী আসা-যাওয়ার বিষয়গুলো এখন বন্ধ থাকবে। কারণ এগুলো ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস কোন কিছুই এখন মিয়ানমার অংশে নাই। সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে।এর বাইরে যে এলাকা থাকবে সেখানে যোগাযোগ চলতে পারে।“কারণ অনির্দিষ্টকালের জন্য তো সীমান্ত বন্ধ থাকতে পারে না। আমাদের রোহিঙ্গারা আছে, ওপারে আরও রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একটা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়তো আছে।”

তিনি বলেন, এই সংকটের একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্তে একটা অচল অবস্থা বিরাজ করবে এবং স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমারের সাথে ওই সীমান্ত এলাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বন্ধ থাকবে।টেকনাফ সীমান্তের কথা উল্লেখ করে মি. ইসলাম বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে মিয়ানমার সরকারের ব্যবসা ও ইমিগ্রেশন দেখার জন্য সরকারি কর্মকর্তা থাকবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সীমান্ত খোলা থাকবে। এরপর পরিস্থিতি যদি ভেঙ্গে পড়ে এবং কোন কর্মকর্তা না থাকে তাহলে তো সীমান্তসহ সব কিছুই বন্ধ করে দিতে হবে।

বেসামরিক প্রতিরক্ষা

স্থানীয় বাসিন্দাদের সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলো থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এরইমধ্যে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে চলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব:) ইমদাদুল ইসলাম।মি. ইসলাম বলেন, রাখাইন রাজ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছে তা শিগগিরই শেষ হবে বলে মনে করেন না তিনি।

আর তাই “তাদেরকে (স্থানীয় বাসিন্দাদের) এলাকা ছাড়া করা যাবে না। তাদের প্রতিরক্ষার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর গোলাগুলির সময় বাঙালি ও পাহাড়ি বসতিগুলোর প্রতিটি বাড়িতে একটি বা দুইটি করে ট্রেঞ্চ(মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি) খুড়ে রাখা হতো। যাতে করে গোলাগুলির সময় তারা সেগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে।

এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে।“এখানে কি আরাকান আর্মির গতিবিধি বাড়ছে অথবা আরাকান আর্মির উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনও এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করতে যাচ্ছে? হলে, সেসব এলাকায় পূর্ব একটা সংকেত দেয়া যেতে পারে।”বেসামরিক ব্যবস্থাপনায় যেগুলো সাধারণ মানুষের প্রতিরক্ষায় কাজ করে সেগুলো প্রয়োগের চিন্তা করতে হবে।দীর্ঘ মেয়াদে যদি এই সংকট চলতে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্কতার সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এর আগে সীমান্তে যখন মর্টার শেল পড়েছে বা হেলিকপ্টার আমাদের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করেছে, তখন মিয়ানমার সরকারের কাছেই প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানানো হয়েছে।একইভাবে আরাকান আর্মি বা অন্য কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠীও যদি একই ধরনের লঙ্ঘনের মতো কোন ঘটনা ঘটায় বা সীমান্তের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে তাহলেও সেটি মিয়ানমারের সরকারকেই কূটনীতিক মাধ্যমে সমাধানের জন্য চাপ দিতে হবে।

বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ?

বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগের বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। অনেকে বিদ্রোহীদের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগকে উৎসাহিত করলেও অনেকে আবার বলছেন যে, এতে করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে।এয়ার কমোডর (অব:) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, কারণ আরাকান আর্মির সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, যোগাযোগ করা উচিতও হবে না। তবে তারা যদি স্থায়ীভাবে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ কিছু একটা হয়তো স্থাপন হতে পারে।

 “আরাকান আর্মি যদি দীর্ঘসময় রাখাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকে, এবং রাখাইন অঞ্চলে যদি তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তাহলে, তখন তাদের সাথে আনুষ্ঠানিক না হলেও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ করতেই হবে,” বলেন তিনি।তিনি বলেন, তবে এই মুহূর্তে আসলে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। কারণ মিয়ানমারের মোট ভূখণ্ডের ৭০ শতাংশের মতো এখন হয় বিদ্রোহীদের দখলে নাহলে হয়তো কিছু জায়গা নিয়ে জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত চলছে। আর মাত্র ৩০ শতাংশ ভূখণ্ডে জান্তা সরকারের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে।

মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের সীমান্তের সাথে যারা থাকবে তারা কোন বৈধ সরকার কিনা সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে আসবে। এছাড়া তাদের সাথে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে কিনা, বাংলাদেশের সাথে তাদের আচরণ বা নীতি কী হবে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।তিনি বলেন, দুই দেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে যাতে দুই দেশের মানুষই নিরাপদে থাকে।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ যেহেতু কোন ধরণের সংঘাতে জড়াতে চায় না, তাই সীমান্তের পাশে যেই থাকুক না কেন তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমেই এগুতে হবে, আর কোন উপায় নেই।অবশ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব:) ইমদাদুল ইসলাম মনে করেন, বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হলে তা হবে হিতে বিপরীত।“তখন মিয়ানমার সামরিক জান্তা হয়তো একটা বার্তা পেতে পারে যে বাংলাদেশ তাদের উস্কে দিচ্ছে। সুতরাং এ ধরণের কোন ফাঁদে আমাদের এখন পা দেয়া যাবে না।”

যদি আরাকান আর্মি দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যের দখলে থাকে তাহলে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে পারে। জাতিসংঘ তখন প্রস্তাব তুলবে।“এই দুই পক্ষের মধ্যে মাঝামাঝি তখন অবস্থান নেবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। তখন কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুযোগ তৈরি হবে।”তিনি মনে করেন, এখানে বাংলাদেশ কতটা কূটনৈতিক দূরদর্শীভাবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে সেটিই এখন দেখার বিষয় হবে। কারণ এখন এই সমস্যার সাথে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মাধ্যমকে এই সংকটের মুখোমুখি করা যাবে।

সূত্র : বিবিসি