ইসলামে গৃহকর্মীর অধিকার

ইসলামে গৃহকর্মীর অধিকার

ফাইল ছবি

গৃহকর্মীর সবরকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এছাড়াও গৃহকর্মীর সঙ্গে অমানবিক ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ধনীদের জীবন গরিবের সহযোগিতা ছাড়া চলে না। আর্থিক প্রয়োজনে দরিদ্ররা ধনীদের শ্রম দেয়। এটি তাদের পেশা মাত্র। গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করাও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি পেশা। একে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদের ওপর কঠিন বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বা অমানবিক আচরণ করা ইসলামি আদর্শের লঙ্ঘন।

আল্লাহ তাআলার একটি হেকমত যে, তিনি কাউকে ধনী আবার কাউকে গরিব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সবাই ধনী হলে অথবা সবাই দরিদ্র হলে কেউ কাউকে সহযোগিতা করার সময় পেত না। ফলে পৃথিবীর শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যেত। এছাড়াও বান্দাদের পরীক্ষা করা এবং তাদের ধৈর্য ও শুকরিয়া যাচাই করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মূলত আল্লাহ নিজের জন্য দায়িত্ব করে নিয়েছেন যে, সৃষ্টিকে রহমত ও করুণা করা। তিনি ধনী-গরিব সবাইকে সুশৃঙ্খল নিয়মে রিজিক বণ্টন করেন। এখানে অন্যকারো হাত নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি তোমার রবের করুণা বণ্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। আর তারা যা জমা করে তা থেকে তোমার রবের অনুগ্রহ উত্কৃষ্টতর।’ (সুরা জুখরুফ: ৩২)

খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অধিকার
খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। এসব অধিকার থেকে গৃহকর্মীদের বঞ্চিত করা ইসলাম পরিপন্থী। রাসুলুল্লাহ (স.)বিদায় হজের ভাষণে কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, তোমরা দাস-দাসীদের ওপর অত্যাচার করো না। তোমরা যা খাবে দাস-দাসীদের তা খেতে দেবে, নিজেরা যা পরবে তাদের তা পরতে দেবে। (সিলসিলা সহিহাহ: ৭৪০)

রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাআলা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের ওপর এমন কাজ চাপিয়ে দিয়ো না, যা তাদের জন্য বেশি কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে। (বুখারি: ৩০)

অন্য হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত, একবার তার কর্ম তত্ত্বাবধায়ক তাঁর কাছে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গোলামদেরকে তাদের খোরাকি সরবরাহ করেছ? সে বলল, না। তখন তিনি বলেন, তুমি এখনই যাও এবং তাদের খোরাকি দিয়ে দাও। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে সে ওই ব্যক্তির খোরাকি আটক করে রাখে, যার খোরাকি তার জিম্মায় আছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, কোনো ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে যার খাদ্য এই ব্যক্তির জিম্মায় আছে, সে তা নষ্ট করে দেয়। (মুসলিম: ২২০২)

জীবনের নিরাপত্তার অধিকার
গৃহকর্মীরা কর্মস্থলে অনেক সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। অথচ তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যায় হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণে বিচারের রায় ছাড়া যদি কেউ কোনো মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে (মানবতাকে) হত্যা করেছে।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)

একটি হত্যা সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। হত্যা মানবসভ্যতার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে মানবপ্রাণকে আল্লাহ অত্যন্ত মর্যাদাশীল করেছেন, তোমরা তাকে ন্যায়ানুগ কারণ ছাড়া হত্যা করো না।’ (সুরা আনআম: ১৫১)

উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অধিকার
অধীনদের উপযুক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা নিয়োগকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না। (সহিহ বুখারি: ২২২৭)

চিকিৎসার অধিকার
সেবা পাওয়া অসুস্থ ব্যক্তির অধিকার। রোগী যদি গৃহকর্মী হলে সেই দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। সামর্থ্য ও সুযোগ থাকার পরও রোগীর প্রতি যদি অবহেলা করা হয়, কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার...‘যখন যে অসুস্থ হবে তার সেবা করো।’ (সহিহ মুসলিম: ২১৬২) অন্য হাদিসে মহানবী (স.) বলেন, ‘মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের জন্য পাঁচটি অবশ্যকরণীয় রয়েছে...‘রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া।’ (সহিহ মুসলিম: ৫০৩০)

এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমার সেবা করোনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আমি আপনার সেবা কিভাবে করব! আপনি তো জগত্গুলোর প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল? তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না তুমি যদি তার সেবা করতে, তবে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৯)

সুন্দর নামে ডাকার অধিকার
অনেকে গৃহকর্মীদের তাচ্ছিল্য করে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকেন। যেমন- কাইল্যা, ধইল্যা, বুয়া, বেটি ইত্যাদি। এসব তাদের সঙ্গে উপহাসের শামিল। প্রত্যেক মা-বাবা আদর করে সন্তানের নাম রাখেন। সেই নামে ডাকা তাদের অধিকার। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! কোনো পুরুষ যেন অন্য কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা হতে পারে উপহাসকারী অপেক্ষা সে উত্তম। আর কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কেননা হতে পারে উপহাসকারিণী অপেক্ষা সে উত্তম। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। কেউ ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহর কাজ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা করে না, তারাই জালিম।’ (সুরা হুজরাত: ১১)