দ. কোরিয়ার নারীরা কেন সন্তান জন্ম দিচ্ছেন না

দ. কোরিয়ার নারীরা কেন সন্তান জন্ম দিচ্ছেন না

সংগৃহীত

বৃষ্টিস্নাত দুপুরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বন্ধুদের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করছিলেন ইয়েজিন। সিউল উপকণ্ঠের অ্যাপার্টমেন্টটিতে একাই থাকেন ‘হ্যাপিলি সিঙ্গেল’ এই নারী।

খাওয়ার সময় তাদের একজন ফোন বের করে একটি কার্টুন আঁকা ডাইনোসরের মিম নিয়ে মজা শুরু করলেন।

যেখানে ডাইনোসরটি বলেছে, ‘সাবধান, নিজেকে আমাদের মতো বিলুপ্ত হতে দেবেন না।’

সব নারীরা একসাথে হেসে উঠলেন।

‘এটা মজার হলেও ডার্ক, কেননা আমরা জানি যে আমরাই নিজেদের বিলুপ্তির কারণ হতে পারি,’ বলেন ৩০ বছর বয়সী টেলিভিশন প্রযোজক ইয়েজিন।

তিনি কিংবা তার বন্ধুদের কেউই সন্তান নেয়ার বিষয়ে আগ্রহী না। তারা সন্তানবিহীন জীবন বেছে নেয়া ক্রমবর্ধমান নারী সম্প্রদায়েরই অংশ।

বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহার দক্ষিণ কোরিয়ায় আর বছরের পর বছর ধরে তারা নিজেরাই নিজেদের এই রেকর্ড ভাঙছে।

বুধবার প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে এটি আরো আট শতাংশ কমে ০.৭২-এ দাঁড়িয়েছে।

এর মাধ্যমে একজন নারীর জীবদ্দশায় প্রত্যাশিত সন্তানের সংখ্যা বোঝা যায়। অথচ জনসংখ্যা স্থির থাকার জন্য এই সংখ্যা ২.১ হওয়া প্রয়োজন।

এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে কোরিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসার শঙ্কা রয়েছে।

‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’
বিশ্বজুড়েই উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও সেগুলোর অবস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মারাত্মক না।

দেশটি নিয়ে করা অনুমানগুলো ভয়াবহ।

আগামী ৫০ বছরে দেশটিতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে। ফলে কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নেয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যাও ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এবং অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার বয়স হবে ৬৫’র বেশি।

জনসংখ্যা হ্রাসের এই প্রবণতা দেশটির অর্থনীতি, পেনশন ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার জন্য এতটাই ক্ষতিকর যে রাজনীতিবিদরা একে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন।

সন্তান থাকা দম্পতিদের জন্য নগদ অর্থ প্রদান থেকে শুরু করে মাসিক বাজেট, আবাসনে ভর্তুকি এবং বিনামূল্যে ট্যাক্সি বরাদ্দ করা হয়েছে।

বিবাহিতদের ক্ষেত্রে হাসপাতালের বিল, এমনকি আইভিএফ চিকিৎসার খরচও দেয়া হয়।

এই ধরনের আর্থিক প্রণোদনা কাজ না করায় রাজনীতিবিদদের আরো ‘সৃজনশীল’ সমাধান ভাবতে হয়েছে।

যেমন- শিশুর যত্ন নেয়ার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আয়া নিয়োগ করা ও তাদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা এবং ৩০ বছর হওয়ার আগেই কোনো পুরুষের তিনটি সন্তান থাকলে তাকে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি দেয়া।

এটি মোটেও বিস্ময়কর নয় যে নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে তরুণদের- বিশেষ করে নারীদের চাহিদাগুলো না শোনার অভিযোগ রয়েছে। আর তাই সন্তান না নেয়ার কারণগুলো বুঝতে এক বছর যাবৎ আমরা পুরো দেশ ঘুরে ঘুরে নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি।

কোরিয়াতে কারো একা থাকার বিষয়টি জীবনের সাময়িক পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পাঁচ বছর আগে তিনি বিয়ে না করার এবং সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

‘কোরিয়াতে ডেট করার মতো পুরুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি কাজ এবং শিশুর যত্ন সমানভাবে ভাগ করে নেবেন।’

তিনি বলেন, ‘আর যে নারীরা একাই সন্তান নেন, তাদের ভালোভাবে দেখা হয় না।’

দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০২২ সালে বিয়ে ছাড়া কেবল দুই শতাংশ শিশু জন্ম নিয়েছে।

‘কাজের চিরস্থায়ী চক্র’
এর পরিবর্তে ইয়েজিন টেলিভিশনে তার ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেয়াকেই বেছে নিয়েছেন। আর এই কাজ করে সন্তান বড় করার জন্য যথেষ্ট সময়ও পাওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন তিনি।

কোরিয়া দীর্ঘ কর্মঘণ্টার জন্য কুখ্যাত।

ইয়েজিন চিরাচরিত ৯টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কাজ করেন (কোরিয়ান ৯টা থেকে ৫টার সমান)। তবে তিনি সাধারণত রাত ৮টার আগে অফিস থেকে বের হন না, আর তার ওপরে ওভারটাইমতো থাকেই।

বাড়িতে ফেরার পর তার কেবল ঘর পরিষ্কার অথবা ঘুমানোর আগে ব্যায়ামের মতো সময় থাকে।

‘আমি আমার কাজটা ভালোবাসি, এটি আমাকে পূর্ণতা দেয়,’ বলেন তিনি।

‘কিন্তু কোরিয়াতে কাজ করা কঠিন, এখানে আপনি কাজের এক চিরস্থায়ী চক্রে আটকে যাবেন।’

ইয়েজিন বলেন, ‘চাকরিতে আরো ভালো করার জন্য অবসর সময়ে তার পড়াশোনার চাপ থাকে।’

‘কোরিয়ানদের এই মানসিকতা রয়েছে যে আপনি যদি ক্রমাগত আত্ম-উন্নতির জন্য কাজ না করেন, তবে আপনি পিছিয়ে পড়বেন এবং ব্যর্থ হবেন। এই ভয় আমাদের দ্বিগুণ কঠোর পরিশ্রম করায়।’

‘কখনো কখনো সপ্তাহের শেষে আমি আইভি থেরাপি নেই, যাতে করে সোমবার কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি পাই,’ তিনি এমনভাবে কথাটি বলেন যেন এটি ছুটির মধ্যে করা স্বাভাবিক কোনো কাজ।

প্রায় সব নারীদের মতো একই ভয় তিনিও প্রকাশ করেছেন যে একবার কাজ থেকে বিরতি নিলে হয়তো আর কখনো তার কাজে ফেরা হবে না।

‘কোম্পানির চাপ থাকে যে যখন আমাদের সন্তান হবে, তখন চাকরি ছেড়ে দিতে হবে,’ বলেন তিনি।

তিনি তার বোন এবং দুই প্রিয় সংবাদ উপস্থাপকের সাথেও একই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।

‘আমি অনেক বেশি জানি’
এইচআর-এ কাজ করা ২৮ বছর বয়সী একজন নারী তার অভিজ্ঞতার কথা জানান।

তিনি এমন অনেককে দেখেছেন মাতৃত্বকালীন ছুটি নেয়ার পর যাদের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কিংবা তাদের পদোন্নতি আটকে দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনাই কখনো সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্তের জন্য যথেষ্ট ছিল।

কোরিয়াতে পুরুষ এবং নারী উভয়ই তাদের সন্তানের জীবনের প্রথম আট বছরে এক বছরের ছুটি পান। কিন্তু ২০২২ সালে ৭০ শতাংশ নতুন মায়ের তুলনায় মাত্র সাত শতাংশ নতুন বাবা তাদের কিছু ছুটি ব্যবহার করেছেন।

ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে কোরিয়ান নারীরা সবচেয়ে উচ্চ শিক্ষিত, তবুও দেশটিতে লিঙ্গভেদে বেতন বৈষম্য অত্যন্ত বাজে। পুরুষদের তুলনায় বেকার নারীদের গড় অনুপাতও বেশি।

গবেষকরা বলছেন, এতেই প্রমাণিত হয় যে তাদের হয় পেশা নয় পরিবার– যেকোনো একটি বেছে নিতে হচ্ছে। আর এই দুইয়ের মধ্যে ক্রমশই তারা পেশাকেই বেছে নিচ্ছে।

আমি একটি আফটারস্কুল ক্লাবে স্টেলা শিনের সাথে দেখা করি, যেখানে সে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের ইংরেজি শেখায়।

‘বাচ্চাদের দিকে তাকাও। ওরা কী সুন্দর,’ নরম স্বরে বলেন তিনি। কিন্তু ৩৯ বছর বয়সী স্টেলার নিজের কোনো সন্তান নেই। তিনি জানান, এটা কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত ছিল না।

ছয় বছর ধরে বিবাহিত স্টেলা ও তার স্বামী দু’জনই একটি সন্তান চেয়েছিলেন। তবে কাজের ব্যস্ততা আর নিজেদের উপভোগে কখন যে তাদের সময় কেটে গেছে তা টেরই পাননি।

এখনকার জীবনযাপনে যে সন্তান নেয়া ‘অসম্ভব’, তা তিনি মেনেই নিয়েছেন।

‘প্রথম দুই বছর পুরো সময় সন্তানের দেখাশোনার জন্য মায়েদের কাজ ছেড়ে দিতে হয়, এটা আমাকে খুব বিষণ্ণ করে দেবে,’ বলেন তিনি।

‘আমি আমার ক্যারিয়ার আর নিজের যত্ন নিতে ভালোবাসি।’

স্টেলা তার অবসর সময়ে বয়স্ক নারীদের একটি গ্রুপের সাথে কে-পপ নাচের ক্লাসে যান।

সন্তান জন্মের পর কাজ থেকে দুই থেকে তিন বছর কোরিয়ান নারীদের ছুটি নেয়া সাধারণ ঘটনা।

স্বামীর সাথে তিনি পিতৃত্বকালীন ছুটি ভাগ করে নিতে পারেন কি না- এমন প্রশ্ন এক চাহনিতেই খারিজ করে দেন স্টেলা।

‘বিষয়টা এমন যে যখন আমি তাকে দিয়ে বাসন মাজাই, সে সবসময় কিছু একটা মিস করে, আমি তার ওপর নির্ভর করতে পারি না,’ বলেন তিনি।

এমনকি যদি তিনি কাজ ছেড়ে দিতে চান বা পরিবার কিংবা কাজের একটি বেছে নিতে চান সেটাও তার পক্ষে সম্ভব না। কারণ আবাসনের খরচ খুব বেশি হওয়ায় তার সামর্থ্যে কুলাবে না।

বেশিরভাগ সুযোগসুবিধা রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় দেশটির অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী সিউলে বা তার আশেপাশে বাস করে। ফলে সেখানকার অ্যাপার্টমেন্ট এবং সম্পদের উপর বিশাল চাপ থাকে।

স্টেলা এবং তার স্বামী ধীরে ধীরে রাজধানী থেকে আরো দূরে গিয়ে পার্শ্ববর্তী প্রদেশে থাকছে, তারপরও তারা নিজস্ব জায়গা কিনতে পারেননি।

সিউলের জন্মহার ০.৫৫-এ নেমে এসেছে, যা দেশটির মধ্যে সর্বনিম্ন।

এরপর আছে বেসরকারি শিক্ষার খরচ। যদিও বিশ্বজুড়েই সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের সঙ্কট আছে, তবে এই ক্ষেত্রে কোরিয়া সত্যিই আলাদা।

চার বছর বয়স থেকে দেশটির শিশুদের গণিত ও ইংরেজি থেকে শুরু করে গান এবং বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যয়বহুল পাঠ্যক্রম বহির্ভূত ক্লাসে পাঠানো হয়।

এই চর্চা দেশটিতে এতটাই ব্যাপক যে এতে অংশ না নেয়াকে সন্তানের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়, যা কি না তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ কোরিয়াতে এক অকল্পনীয় ধারণা। এসব কারণেই সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ।

২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র দুই শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট টিউশনের জন্য অর্থ দেননি, যেখানে ৯৪ শতাংশ একে আর্থিক বোঝা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এই বিশেষায়িত স্কুলগুলোর একটির শিক্ষক হওয়ার কারণে স্টেলা এই চাপের বিষয়টি খুব ভালোভাবে বোঝেন।

তিনি দেখেন যে বাবা-মায়েরা প্রতি মাসে এক সন্তানের জন্য ৮৯০ ডলার বা প্রায় এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন, যা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।

‘কিন্তু এই ক্লাসগুলো ছাড়া শিশুরা পিছিয়ে পড়ে,’ বলেন তিনি।

‘যখন আমি বাচ্চাদের আশেপাশে থাকি, তখন আমি একটি সন্তান নিতে চাই। কিন্তু আমি আসলে অনেক বেশি জানি।’

কারো কারো জন্য অত্যধিক প্রাইভেট টিউশনের এই ব্যবস্থা খরচের চেয়েও বেশি কিছু।

‘মিনজি’ তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাইছিলেন, তবে তা প্রকাশ্যে নয়। তার যে সন্তান হবে না তা তিনি বাবা-মাকে জানাতে প্রস্তুত নন।

‘তারা একইসঙ্গে খুব অবাক এবং হতাশ হবেন,’ বলছিলেন উপকূলীয় শহর বুসানে স্বামীর সাথে বসবাস করা এই নারী।

মিনজি স্বীকার করে নেন যে তার শৈশব এবং ২০ বছরের সময়টায় তিনি অসুখী ছিলেন।

‘আমি আমার সারা জীবন পড়াশোনা করে কাটিয়েছি,’ বলেন তিনি।

প্রথমে একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য, তারপরে সরকারি চাকরির জন্য আর তারপরে ২৮ বছর বয়সে প্রথম চাকরি পেতে।

তিনি স্বপ্ন দেখতেন একজন শিল্পী হওয়ার।

‘আমাকে সীমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তাও আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য না, কেবল এক মাঝারি জীবনযাপনের জন্য,’ বলেন তিনি।

‘এটা খুব শক্তি ক্ষয় করছে।’

এখন এই ৩২ বছর বয়সে এসে মিনজি কিছুটা মুক্ত বোধ করেন এবং নিজেকে উপভোগ করতে পারেন।

তিনি ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। এখন পানির নিচে ডাইভ দেয়া শিখছেন।

তবে তিনি একটি শিশুকে প্রতিযোগিতার নামে একই ধরনের দুর্দশার মধ্যে ফেলতে চান না।

তার মতে, ‘কোরিয়া শিশুদের জন্য সুখের জায়গা না।’

তার স্বামী সন্তান চান, এটা নিয়ে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করতেন। অবশেষে স্বামী তার ইচ্ছা মেনে নিয়েছেন।

তিনি স্বীকার করেছেন, মাঝে মাঝে তার হৃদয় কেঁপে ওঠে, কিন্তু পর মুহূর্তেই তার মনে পড়ে কেন তা সম্ভব না।

হতাশাজনক সামাজিক বৈশিষ্ট্য
‘সিঙ্গেল প্যারেন্টিং ম্যারিজ’ বা ‘একক সন্তান পালনের বিয়েতে’ আছেন ডেজিয়ন শহরের জুংইয়ন চুন।

সাত বছর বয়সী মেয়ে এবং চার বছরের ছেলেকে স্কুল থেকে নেয়ার পর তার স্বামী কাজ থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি কাছাকাছি খেলার মাঠ ঘুরে বেড়ান। তিনি খুব কমই শোয়ার সময়ের আগে বাড়ি ফিরতে পারেন।

‘আমার মনে হয়নি সন্তান নেয়া খুব বড় কোনো সিদ্ধান্ত হবে, ভেবেছিলাম আমি খুব দ্রুত কাজে ফিরতে পারব,’ বলছিলেন তিনি।

কিন্তু শিগগিরই সামাজিক এবং আর্থিক চাপ শুরু হয় আর বিস্ময়ের সাথে তিনি নিজেকে সন্তানদের একক অভিভাবক হিসেবে আবিষ্কার করেন। ট্রেড ইউনিয়ন করা তার স্বামী শিশুর যত্ন কিংবা বাড়ির কাজে তাকে কোনো সাহায্য করেননি।

‘আমার এত রাগ লাগতো,’ বলেন তিনি। ‘আমি সুশিক্ষিত ছিলাম এবং শিখেছিলাম যে নারীরা সমান, তাই আমি এটি মেনে নিতে পারিনি।’

এটাই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু।

বিগত ৫০ বছরে কোরিয়ার অর্থনীতি যে দ্রুত গতিতে বিকশিত হয়েছে, তা নারীদের উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। একইসাথে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকার ক্ষেত্রে সেই বিকাশ একই গতিতে হয়নি।

হতাশ হয়ে জুংইয়ন অন্যান্য মায়েদের পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। ‘আমি দেখলাম, ওহ, আমার যে বন্ধু একটি শিশুকে বড় করছে সেও বিষণ্ণ আর রাস্তার পাশের আমার বন্ধুটিও হতাশাগ্রস্ত আর আমি বুঝতে পারি, ‘ওহ এটা একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য।’

তিনি তার অভিজ্ঞতাগুলো ডুডল আকারে অনলাইনে পোস্ট করতে শুরু করেন। ‘গল্পগুলো আমার ভেতর থেকে বের হচ্ছিল,’ বলেন তিনি।

তার এই ডিজিটাল কমিক বা ‘ওয়েবটুন’ বিশাল সাফল্য পায়, কারণ সারাদেশের নারীরাই তার কাজের সাথে সম্পর্কিত। জুংইয়ন এখন তিনটি প্রকাশিত কমিক বইয়ের লেখক।

এখন তিনি তার রাগ ও অনুশোচনার পর্যায় অতিক্রম করেছেন।

‘আমার শুধু মনে হয়, আমি যদি বাচ্চাদের লালন-পালনের বাস্তবতা সম্পর্কে এবং মায়েদের থেকে কতটা প্রত্যাশা করা হয় সে সম্পর্কে আরও জানতাম!’ বলছিলেন তিনি।

‘নারীরা এখন সন্তান না নেয়ার কারণ হলো তাদের এই বিষয়ে কথা বলার সাহস আছে।’

কিন্তু জুংইয়ন দুঃখী, তিনি বলেন, নারীরা মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নয়তো ‘পরবর্তী সময়ে তারা দুঃখজনক পরিস্থিতিতে পড়তে বাধ্য হবে।’

কিন্তু এই ক্ষমতা পেয়ে মিনজি কৃতজ্ঞ।

‘আমরাই প্রথম প্রজন্ম যারা পছন্দ করতে পারছি। এর আগে আমাদের সন্তান নিতেই হতো। এখন আমরা না নেয়াটাই বেছে নিচ্ছি, কারণ আমাদের সে ক্ষমতা আছে।’

‘সম্ভব হলে আমি ১০টি সন্তান নিতাম’
দুপুরের খাবারের পর ইয়েজিনের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে তার বন্ধুরা বই ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।

কোরিয়ার জীবন নিয়ে ক্লান্ত ইয়েজিন নিউজিল্যান্ড চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি উপলব্ধি করেন যে কেউ তাকে এখানে থাকতে বাধ্য করছে না।

তিনি খুঁজে বের করেছেন কোন দেশগুলো লিঙ্গ সমতায় উপরের দিকে আছে আর তাতে নিউজিল্যান্ড স্পষ্টভাবে বিজয়ী দেশ।

‘এটা এমন একটি জায়গা যেখানে পুরুষ এবং নারীদের সমান অর্থ দেয়া হয়,’ তিনি প্রায় অবিশ্বাসের সাথে বলেন, ‘তাই আমি যাচ্ছি’।

আমি ইয়েজিন এবং তার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করি কোনো কিছু তাদের এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে কি না।

মিনসুংয়ের উত্তর আমাকে অবাক করে দেয়।

‘আমি সন্তান চাই। সম্ভব হলে আমি ১০টি সন্তান নিতাম।’

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি তাহলে তাকে কী বাধা দিচ্ছে?

২৭ বছর বয়সী এই নারী আমাকে জানান, তিনি উভকামী আর তার সমকামী সঙ্গী রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় সমকামী বিয়ে অবৈধ, আর সাধারণত অবিবাহিত নারীদের গর্ভধারণের জন্য শুক্রাণু দাতা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয় না।

‘আশা করি, একদিন এর পরিবর্তন হবে, আর আমি যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে পারব এবং তার সঙ্গে সন্তান নিতে পারব,’ বলেন তিনি।

কোরিয়ার জনসংখ্যা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তার বন্ধুরা বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরে বলেন, যে নারীরা মা হতে চান তাদের অনুমতি দেয়া হয় না।

তবে মনে হচ্ছে, রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে সঙ্কটের গভীরতা ও জটিলতা মেনে নিচ্ছেন।

এই মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল স্বীকার করেছেন যে সমস্যা থেকে বের হতে তাদের প্রচেষ্টা ‘কাজে লাগেনি’ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ‘মাত্রাতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ’।

তিনি বলেন যে তার সরকার এখন নিম্ন জন্মহারকে ‘কাঠামোগত সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করবে - যদিও সেটি কিভাবে নীতিতে রূপান্তরিত হবে তা এখনও দেখা বাকি।

এই মাসের শুরুর দিকে আমি নিউজিল্যান্ডে থাকা ইয়েজিনের সাথে যোগাযোগ করেছি, যেখানে তিনি তিন মাস যাবৎ বসবাস করছে।

তিনি তার নতুন জীবন, বন্ধু আর পাবের রান্নাঘরে তার কাজ নিয়ে আলাপ করছিলেন। ‘আমার কাজ-জীবনের ভারসাম্য এখন অনেক ভালো,’ বলেন তিনি।

সপ্তাহে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারেন।

‘আমি কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সম্মানিত বোধ করি আর এখানকার মানুষ অন্যকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না,’ যোগ করেন তিনি।

‘আর এই কারণেই আমি বাড়ি ফিরতে চাই না।’

সূত্র : বিবিসি