হলুদের কারকিউমিন শরীরে প্রদাহের প্রবণতা কমায়

হলুদের কারকিউমিন শরীরে প্রদাহের প্রবণতা কমায়

হলুদের কারকিউমিন

এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, বাঁচতে গেলে লড়তে হবে নিজের শরীর দিয়েই। তাই রসনার চেয়ে বেশি কদর পুষ্টিগুণের। বিদেশি ভাল-মন্দের বদলে বাঙালির ঘরোয়া খাবার। তারই সঙ্গে মানুষ মজে উঠেছেন ঘরোয়া উষ্ণ হলুদ-দুধে। স্বাদ ও উপকার বাড়াতে কখনও তাতে মেশানো হচ্ছে অ্যামন্ড, কাজু বাদাম। এই পানীয়ের পোশাকি নাম টারমারিক লাত্তে। মধু যোগ করে তার নাম দেওয়া হয়েছে হানি-টারমারিক লাত্তে। কখনও আবার সাবেকি হলুদ দুধে মেশানো হচ্ছে আদা, গোলমরিচ, দারুচিনি ও মধু বা ম্যাপল সিরাপ, কখনও বা অন্য কিছু। ভারী হচ্ছে উপকারের পাল্লা। 

যে উপাদানটির জন্য হলুদের এত নাম-ডাক, কারকিউমিন, তাকে পুরোদস্তুর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দুধ। ডাবল টোনড নয়, সরে মাখামাখি গাঢ় দুধ। কারণ এমনিতেই হলুদে কারকিউমিন থাকে খুব কম, মোটে ৩ শতাংশ। তার উপর পানি দিয়ে খেলে, তার বেশির ভাগটাই শোষিত হয় না। কারকিউমিন ফ্যাটে দ্রবীভূত হয়। কাজেই ফ্যাট জাতীয় খাবারের সঙ্গে খেলে তাকে পাওয়া যায় পুরোপুরি। আরেকটি রাস্তা হল গোলমরিচ দিয়ে বেটে খাওয়া। গোলমরিচে আছে পিপারিন, যা কারমিউমিনের শোষণ প্রায় ২০০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হল, হঠাৎ হলুদ-দুধ বা টারমারিক লাত্তে খাবেন কেন? সে কি করোনা ঠেকায়? আয়ুর্বেদ চিকিৎসক দেবাশিস ঘোষ জানিয়েছেন, "ঠিক তা নয়। হলুদের কারকিউমিন শরীরে প্রদাহের প্রবণতা কমায়। যার হাত ধরে ক্রনিক অসুখ-বিসুখের প্রকোপ কমে। যেমন, হৃদরোগ, ডায়াবিটিস, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, যার প্রত্যেকটিই কোভিডের কো-মর্বিডিটি। বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। জীবাণু সংক্রমণ ঠেকায়। সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশির প্রকোপ কম থাকে। তবে, এ নিয়ে এখনই শেষ কথা বলা যাবে না।"

দারুচিনি ও আদাও প্রদাহ কমাতে পারে। ফলে তিনটি মিশিয়ে খেলে আরও ভাল কাজ হয়। কোভিডের ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ কমাতেও এদের ভূমিকা আছে। হাই কোলেস্টেরলের রোগীকে রোজ ১২০ মিলিগ্রাম দারুচিনি পাউডার খাইয়ে দেখা গেছে, খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমেছে, বেড়েছে ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা, ট্রাইগ্লিসারাইড কমেছে। ৪১ জন ডায়াবিটিসের রোগীকে প্রতিদিন দুই গ্রাম করে আদার গুঁড়ো খাইয়ে ১২ সপ্তাহ পরে দেখা যায়, হৃদরোগের আশঙ্কা ২৩-২৮ শতাংশ কমেছে। নিয়মিত ১-৬ গ্রাম দারুচিনির গুঁড়ো খেলে ফাস্টিং সুগার প্রায় ২৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। কমতে পারে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সও। সঙ্গে অল্প আদা খেলে ফাস্টিং সুগার আরও ১২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।

হলুদ-দুধের অন্য উপকার
•     প্রদাহ কমানোর গুণেই কিস্তিমাত করে হলুদ। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্রদাহ কমানোর ওষুধ খেলে যতটা কমে, নিয়মিত কারকিউমিন খেলেও কমে সেই মাত্রাতেই। ৪৫ জন রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীকে দিনে ৫০০ মিলিগ্রাম কারকিউমিন খাইয়ে দেখা যায়, ওষুধ না খাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ব্যথা কম থাকছে। ২৪৭ জন অস্টিওআর্থ্রাইটিসের রোগীকে কারকিউমিন খাইয়ে ৬ সপ্তাহ ধরে স্টাডি করে দেখা যায়, তাঁদের ব্যথার ওষুধের প্রয়োজন কমেছে।

•     নিয়মিত হলুদ-দুধ খেলে কারকিউমিনের প্রভাবে বিডিএনএফ নামে এক রাসায়নিকের পরিমাণ বাড়ে বলে কমে অ্যালঝাইমারের প্রকোপ। ব্রেনের কার্যকারিতা বাড়ে। আবার অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছ্‌ দারুচিনি খেলে ব্রেনে টাউ প্রোটিনের পরিমাণ কমেও অ্যালঝাইমারের উপকার হয়। উপকার হয় পার্কিনসন'স রোগের।

•     হলুদ খেলে মন ভাল থাকে। ৬০ জন গভীর অবসাদে ভুগছেন এমন মানুষের কাউকে দেওয়া হয় কারমিউমিন, কাউকে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, কাউকে দুটোই। ৬ মাস পরে দেখা যায় প্রথম দুটো গ্রুপের সদস্যদের একই রকম ফলাফল হয়েছে। আর তৃতীয় গ্রুপের মানুষেরা সবচেয়ে ভাল আছেন।

•     হলুদ, আদা, দারুচিনি সবার মধ্যেই ক্যানসার ঠেকানোর গুণাবলি আছে। তবে কোনটা কী পরিমাণে খেলে কতটা কাজ হবে, তা জানতে গেলে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।

•     দুধে আছে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি। নিয়মিত খেলে সাধারণ স্বাস্থ্য ভাল থাকে। ভাল থাকে হাড় ও পেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও এর বিরাট ভূমিকা।


কখন খাবেন, কতটা খাবেন
সকালে খালি পেটে খান। এর পর আধঘণ্টা আর কিছু খাবেন না। রাত্রে শোওয়ার আগেও খেতে পারেন, ঘুম ভাল হবে।
দিনে ২৫০ মিলিগ্রাম হলুদ খেলে সব দিক বজায় থাকে। যদিও বিজ্ঞানীদের মতে, প্রদাহ কমানোর উপকার পেতে গেলে দিনে ৫০০-১০০০ মিলিগ্রাম খাওয়া দরকার। সকালে-রাত্রে এক চা-চামচ করে খান। রান্নায় ব্যবহার করুন। বেশি খেলে আবার ক্ষতি হতে পারে। দারুচিনি সারাদিনে এক চা চামচের বেশি না খাওয়াই ভাল।

হলুদের ক্ষতি

•     রক্ত পাতলা রাখে বলে গর্ভাবস্থায় খুব বেশি না খাওয়াই ভাল।

•     যাঁদের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা আছে, তাঁরাও খাবেন রয়েসয়ে। কারণ হলুদে ২ শতাংশ অক্সালেট আছে, যার প্রভাবে কারও কারও কিডনিতে পাথর হতে পারে।

•     আদা ও দারুচিনি বেশি খেলেও সমস্যা হয়।

কীভাবে বানাবেন
হলুদ-দুধ বানাতে চাইলে ১২০ মিলিগ্রাম গরুর দুধ বা অ্যামন্ড/ সয়াবিনের দুধে মেশান এক চা-চামচ কাঁচা বা শুকনো গোটা হলুদ বাটা। বিশেষ হলুদ-দুধে দুধ ও হলুদের সঙ্গে অল্প কিছুটা আদা কুচি, আধ চা-চামচ দারুচিনির গুঁড়ো, এক চিমটে গোল মরিচ গুঁড়ো মিশিয়ে ফোটান। ফুটতে শুরু করার পর আঁচ কমিয়ে ১০ মিনিট ধরে ফোটাতে থাকুন। নামিয়ে ছেঁকে নিন। মোটামুটি দিন পাঁচেকের মতো বানিয়ে ফ্রিজে রাখতে পারেন। খাওয়ার সময় একটু গরম করে নিলেই হবে। মিষ্টি স্বাদ চাইলে মধু বা ম্যাপল সিরাপ মেশাতে পারেন।