শত চেষ্টায়ও বাড়ছে না রিজার্ভ, কমছে না মূল্যস্ফীতি

শত চেষ্টায়ও বাড়ছে না রিজার্ভ, কমছে না মূল্যস্ফীতি

প্রতীকী ছবি

দেশে দীর্ঘদিন ধরেই ডলার সংকট চলছে। সংকট ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিলেও কোনোটাই তেমন কাজে আসছে না। কয়েক মাস ধরে ২০ বিলিয়নে উঠানামা করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আবার কিছুতেই সহনীয় পর্যায়ে নামছে না মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ ডিঙ্গিয়ে তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামাতে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন অধরা রয়েছে।

একদিকে ডলার সংকট তথা রিজার্ভে টান অপরদিকে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি সব মিলে ‘দোটানা’ অবস্থায় রয়েছে দেশের অর্থনীতি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা এবং সমন্বয়ের অভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মোট রিজার্ভের পরিমাণ দুই হাজার ৫২৩ কোটি ডলার বা ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম–৬ অনুযায়ী, এক হাজার ৯৯৫ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এই সময়ে মোট রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল (৩০ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলার)। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। তবে বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব আছে, যা শুধু আইএমএফকে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া গত মাসে আকুর বিলও পরিশোধ হয়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এসব কারণেই মূলত রিজার্ভ কমছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের ব্যবহারযোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রতি মাসে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হবে বাংলাদেশের জন্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১১ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলারে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

বর্তমানে ডলারের যে সংকট চলছে, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই কাজে দেয়নি। চলমান এই সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আমার মতে যেটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক্সচেঞ্জ রেটটা বেঁধে দেওয়া। যেখানে খোলা বাজারে বিক্রি করে ৫-৭ টাকা বেশি পাচ্ছে, তারা তো সেভাবেই পাঠানোর চেষ্টা করবে। যাদের কোনো গতি নেই তারা হয়তো তুলবে। কিন্তু যাদের অপশন আছে যে ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি করলে ৫-১৭ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, তারা তো সেভাবেই করবে। হুকুম দিয়ে বাজার দর নির্ধারণ করা, এটা থেকে যদি বেরিয়ে আসতে হবে।
— ড. জাহিদ হোসেন, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়
সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া গত মাসে আকুর বিলও পরিশোধ হয়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এসব কারণেই মূলত রিজার্ভ কমছে।

ডলার সংকটের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে ডলারের যে সংকট চলছে, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই কাজে দেয়নি। চলমান এই সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে আমার মতে যেটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক্সচেঞ্জ রেটটা বেঁধে দেওয়া। যেখানে খোলা বাজারে বিক্রি করে ৫-৭ টাকা বেশি পাচ্ছে, তারা তো সেভাবেই পাঠানোর চেষ্টা করবে। যাদের কোনো গতি নেই তারা হয়তো তুলবে। কিন্তু যাদের অপশন আছে যে ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি করলে ৫-১৭ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, তারা তো সেভাবেই করবে। হুকুম দিয়ে বাজার দর নির্ধারণ করা, এটা থেকে যদি বেরিয়ে আসতে হবে।’

অপরদিকে মূল্যস্ফীতি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬ শতাংশ। অথচ কোনো মাসেই তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। যা ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই অবস্থা।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। পণের দাম কম রাখতে টাকার সরবরাহ বাজারে কমানোর লক্ষ্যে সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার দেড়গুণের বেশি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, সুদের হারে সীমা বেঁধে রাখা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের বাড়তি ঋণ পরিশোধ এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গৃহীত পদক্ষেপে সমন্বয় না থাকায় মুদ্রানীতি কাজ করছে না।
— ড সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। তা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং জানুয়ারি মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ ও নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

একইভাবে ২০২৩ সালের মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড সেলিম রায়হান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। পণের দাম কম রাখতে টাকার সরবরাহ বাজারে কমানোর লক্ষ্যে সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার দেড়গুণের বেশি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, সুদের হারে সীমা বেঁধে রাখা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের বাড়তি ঋণ পরিশোধ এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গৃহীত পদক্ষেপে সমন্বয় না থাকায় মুদ্রানীতি কাজ করছে না।’

বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের দেশের ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি এবং অর্থপাচার একই সূত্রে গাথা। ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকে অর্থের টান পড়েছে। এজন্য বন্ডের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি কমছে না।
—ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘অন্যান্য দেশের বিপরীতে বাংলাদেশ প্রায় ১০ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ন্ত্রণ করতে লড়াই করছে। বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি। আমাদের দেশের ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি এবং অর্থপাচার একই সূত্রে গাথা। ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকে অর্থের টান পড়েছে। এজন্য বন্ডের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি কমছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে মুক্তি পেতে এটি বন্ধ করা উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের তদারকির পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে।’

২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘শিগগির মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’ একই বছরের ২২ আগস্ট  ‘নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অভ্যন্তরীণ সববরাহ বাড়িয়ে বৈশ্বিক এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। এছাড়া গত ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রোজার পরেই মূল্যম্ফীতি লক্ষ্যের কাছাকাছি আসবে। এসব আশ্বাসের কোনোটারই বাস্তব প্রতিফলন হয়নি।