নকল বিড়িতে বাজার সয়লাব বছরে ৪৮৮ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

নকল বিড়িতে বাজার সয়লাব বছরে ৪৮৮ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

সংগৃহীত

বিড়ি প্রাচীন শ্রমঘন একটি শিল্প। এই শিল্পে দেশের হতদরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা, শারীরিক বিকলাঙ্গ, বিধবাসহ সুবিধাবঞ্চিত প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র চলমান রয়েছে বিড়ি নিয়ে। নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকা বিড়িকে সম্প্রতিক সময়ে মোকাবেলা করতে হচ্ছে নতুন সমস্যার সাথে। সেটি হচ্ছে নকল বিড়ি।

বিড়িরি ওপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ায় নকল বিড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিড়ি থেকে সরকার নির্ধারিত শুল্ক আদায়ের মাধ্যম হচ্ছে ব্যান্ডরোল। বিড়ি উৎপাদনকারীরা সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত দামে ব্যান্ডরোল কিনে তা বিড়ির প্যাকেটে লাগিয়ে দেয়। বৈধ ব্যান্ডরোল সম্বলিত বিড়িই হচ্ছে আসল বিড়ি। পক্ষান্তরে নকল বিড়ি হচ্ছে ব্যান্ডরোল বিহীন, নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত কিংবা একই ব্যান্ডরোল পুন:ব্যবহার করা। যে সকল বিড়ি সরকার নির্ধারিত শুল্ক প্রদান না করে বিক্রি হয় সেগুলোই নকল বিড়ি।

বর্তমানে ২৫ শলাকার ১ প্যাকেট বিড়ির দাম সরকার নির্ধারন করেছেন ১৮ টাকা, যার মাঝে সরকার নির্ধারিত শুল্ক ৯.০৯ টাকা। তাই ৯ টাকার কম দামে বিক্রি হওয়া বিড়িকে নকল বিড়ি হিসেবে গণ্য করা যায়। কম দামে ভোক্তার কাছে বিড়ি বিক্রির প্রত্যাশা থেকেই নকল বিড়ির উৎপত্তি। বিড়ির দাম যখন কম ছিল, তখন নকল বিড়ির অস্তিত্ব তেমন ছিল না।

বিশ বছর আগে বিড়ির দাম ছিল ২.৮৩ টাকা। তারপরে বিড়ির দাম ক্রমাগতভাবে বেড়েছে, যার মাঝে রয়েছে কয়েকবারের অতিমাত্রায় বৃদ্ধি-২০১৫-১৬ বছরের ৪.৯১ টাকা থেকে ২০১৬-১৭ তে ৭.১০ টাকা, ২০১৭-১৮ তে ১২.৫০ টাকা, ২০১৯-২০ এ ১৪.০০ টাকা ও ২০২০-২১ এ ১৮.০০ টাকা। বিড়ির দাম যখন বেড়েছে, তখন কমদামে বিড়ি প্রাপ্তির একটা বাজার তৈরি হয়েছে। আর নকল বিড়ি সেই বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে।

বিড়ির অধিকাংশ ভোক্তাই হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণীর। সারা বাংলাদেশের সর্বত্রই রয়েছে এর বাজার। সমগ্র দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট দোকান ও ভ্রাম্যমাণ হকারদের মাধ্যমে বিক্রি হয় বিড়ি। যেহেতু সরকার নির্ধারিত কর প্রদান করতে হয় না, নকল বিড়ি আসল বিড়ির চাইতে অনেক কম দামে বিক্রি করা যায়। ফলে দরিদ্র শ্রেণীর ভোক্তারা সহজেই নকল বিড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়। নকল বিড়ি বিক্রিতে মুনাফা বেশি বলে তা বিক্রির জন্য ছোট ছোট দোকানী ও ভ্রাম্যমাণ হকারদের আগ্রহও বেশি।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল সম্প্রতি নকল বিড়ির উপরে গবেষণা করেছে। তারা জানাচ্ছে, সর্বনিম্ন ৫ টাকাতেও বিড়ির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। ৯ টাকা ও তার কমে বিক্রিত বিড়ির ব্র্যান্ডের সংখ্যা ৭৫১ টি। বাংলাদেশে সর্বমোট মাসে ৪,৪৭,১৬,৮৮৫ প্যাকেট নকল বিড়ি বিক্রি হয়। প্রতি প্যাকেটে ৯.০৯ টাকা হিসেবে কর ফাঁকির পরিমান মাসে ৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর সরকার বছরে রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ৪৮৮ কোটি টাকা। বিড়ির মূল্য বাড়ানোর পর তাৎক্ষণিকভাবে কর আহরণ বৃদ্ধি পেলেও, পরবর্তীতে তা ধরে রাখা যায়নি, বরঞ্চ কর আহরণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিড়ির মূল্য ছিল প্যাকেট প্রতি ১২.৫০ টাকা ও মোট আহরিত কর ছিল ৮৯৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি প্যাকেট বিড়ির মূল্য ছিল ১৪ টাকা আর আহরিত কর ছিল ৯৯৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮ টাকা ছিল প্রতি প্যাকেট বিড়ির দাম আর কর আহরিত হয়েছিল ১০৮৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট কর আহরিত হয়েছিল যথাক্রমে ১০৪৬ কোটি ৯৮ লাখ টকা এবং ১০৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা আর দুই অর্থবছরেই ১৮ টাকা ছিল প্রতি প্যাকেট বিড়ির দাম। উক্ত গবেষণা আরও জানাচ্ছে, বিড়ির মূল্য বৃদ্ধি সাথে নকল বিড়ি উৎপাদনের সংযোগ সরাসরি আর কর প্রদানকৃত আসল বিড়ির উৎপাদন কমেছে বিড়ির মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে।

বিড়ি একটি শ্রমঘন কুটির শিল্প। মূলতঃ দরিদ্র অঞ্চলে বিড়ি শিল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে অন্য কোন শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। দরিদ্র, নদী ভাঙনের শিকার জনপদে অশিক্ষিত নারীদের কর্মসংস্থানের ঠিকানা বিড়ি। বিড়ি উৎপাদনের সাথে জড়িত হবার নমনীয় শর্তাবলির কারণে দরিদ্র গ্রামীন এলাকার নারীরা গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি বিড়ি উৎপাদনের সাথে জড়িত হন বাড়তি রোজগার করে পরিবারের সচ্ছলতার প্রত্যাশায়। প্রতিবন্ধী, পঙ্গু, চলনশক্তিহীনের কর্মসংস্থানের আশ্রয় বিড়ি।

বিড়ি শিল্পের বিকল্প নেই গ্রামীন অশিক্ষিত, দরিদ্র নারী ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে টিকে থাকতে হলে আর উচ্চ আয়ের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। শ্রমঘন কুটির শিল্প বিড়ি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে তাদের জন্য যারা প্রচলিত কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ করতে পারে না। দরিদ্র নারী, প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিড়ি অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে অনন্য। বিড়ির এই অবস্থানকে শক্তিশালী করতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে।

বিড়ির দাম বাড়িয়ে নকল বিড়ির বাজার সৃষ্টি এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টায় ছুরিকাঘাত। বিড়ির দাম বাড়লে সরকারের রাজস্ব আহরণ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিড়ির মূল্য বৃদ্ধি নকল বাজার সৃষ্টি করে বিড়িকে ক্ষতিগ্রস্থ করে কর্মসংস্থান তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্থ করছে।

অবিলম্বে বিড়ির দাম কমিয়ে সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির ব্যবস্থার পাশাপাশি নকল বিড়ির বাজার উচ্ছেদ করে প্রকৃত বিড়ি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।