স্ত্রীর সঙ্গে যেভাবে প্রেমময় সম্পর্ক গড়তে বলে ইসলাম

স্ত্রীর সঙ্গে যেভাবে প্রেমময় সম্পর্ক গড়তে বলে ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত

একটি সুন্দর, সুখী ও আদর্শ পরিবার গঠনে স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামীরও ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে স্ত্রীর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে তা করতে হবে? এ বিষয়ে হাদিস থেকে কিছু নির্দেশনাবলী তুলে ধরছি—

পরিবারে সময় দেওয়া
স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়া এবং মানসিক সাপোর্ট দেওয়া আদর্শ স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী-সন্তানদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। সংযমী হতে হবে কথাবার্তায়। সাহাবি উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন— ‘আমি একদিন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী জানতে চাইলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, কথাবার্তায় সংযমী হও, পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থান যেন দীর্ঘ হয় এবং নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হও।’ (তিরমিজি: ২৪০৬)

ঘরোয়া কাজে সহায়তা
ঘরোয়া কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করাকে আমাদের সমাজে লজ্জার বিষয় মনে করা হলেও এটি কিন্তু নবীজির সুন্নত এবং আদর্শ স্বামীর বৈশিষ্ট্য। ‘উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, নবীজি কি পরিবারের লোকদের ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, নবীজি ঘরের লোকদের তাদের কাজে সহযোগিতা করতেন এবং নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য যেতেন।’ (বুখারি: ৬৭৬) এমনকি ‘রাসুলুল্লাহ (স.) নিজ হাতেই তার পরিধেয় কাপড় সেলাই করতেন। প্রয়োজনে নিজের জুতা নিজেই সেলাই করে নিতেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩৭৫৬)

স্ত্রীর মতামত নেওয়া
বিশ্বনবী (স.) শুধু ঘরোয়া বিষয়েই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নিজের স্ত্রীদের মতামত নিতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে নবীজি (স.) স্বীয় স্ত্রী উম্মে সালমা (রা.)-এর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় যা অতি কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়। (বুখারি: ২৭৩১)

পরিপাটি থাকা
স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা আদর্শ স্বামীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি স্ত্রীর অধিকার। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি, যেমন আমিও চাই স্ত্রী আমার জন্য সাজুক।’ (বায়হাকি: ১৪৭২৮)

স্ত্রীর পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসা
স্ত্রীর পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসা একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে হাদিসে একটি সুন্দর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, “আমি খাদিজা (রা.) ছাড়া নবী (স.)-এর পত্নীদের আর কাউকে ঈর্ষা করিনি, যদিও আমি তাঁকে তেমন পাইনি। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) যখন বকরী জবেহ করতেন তখন বলতেন, এর গোশত খাদিজার বান্ধবীদের পাঠিয়ে দাও। একদিন আমি তাঁকে রাগান্বিত করলাম, আর বললাম, খাদিজাকে এতই ভালোবাসেন? রাসুলুল্লাহ (স.) তখন বললেন, তার ভালোবাসা আমার অন্তরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে”। (মুসলিম: ২৪৩৫)

সন্তানের যত্ন নেয়া
সন্তানের যত্ন নেওয়া স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (স.) বাচ্চাদের খুব যত্ন নিতেন। বুখারি ও মুসলিমে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, “আমি নামাজ শুরু করে লম্বা করতে চাই, তবে শিশুর কান্না শুনে সংক্ষিপ্ত করে শেষ করি, কারণ আমি মায়ের কষ্টের তীব্রতা জানি”। হজরত আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, “পরিবার পরিজনের প্রতি রাসুল (স.)-এর মতো দয়াবান কাউকে দেখিনি”। (সহিহ ইবন হিব্বান: ৫৯৫০)

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ
ভালোবাসা মূলত কাজে প্রমাণ করার বিষয়, কিন্তু মাঝেমধ্যে মুখেও প্রকাশ করতে হয়। কারণ, স্ত্রীর মন স্বামীর ভালোবাসার কথা শোনার জন্য সবসময় লালায়িত থাকে। তাছাড়া কথার মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো নবীজির সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (স.) বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীদের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কথা বলতেন। যেমন, হজরত খাদিজা (রা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসলিম: ২৪৩৫) আয়েশা (রা.)-এর প্রশংসা করে নবীজি (স.) বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন সবার সেরা, নারীদের মধ্যে আয়েশা সবার সেরা।’(বুখারি: ৩৪১১)

প্রেম ও রোমান্টিকতা
নবীজি (স.)-এর পবিত্র দাম্পত্য জীবনে স্বীয় স্ত্রীদের সঙ্গে আন্তরিকতা ও রোমান্টিকতার এত সব চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, যা একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের উৎকৃষ্ট উপমা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে উম্মুল মুমিনিনরা এসব ঘটনার বিবরণ এতটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দিয়েছেন, যা তাদের ভেতরকার ভাব-আবেগের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করা পছন্দ করতেন।’ (মুসলিম: ৩০০)

আয়েশা (রা.) আরও বলেন, ‘কখনও আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতাম এবং আমাকে খুশি করতে তিনি প্রতিযোগিতায় ইচ্ছা করেই নিজেকে পেছনে ফেলে দিতেন।’ (মুসনাদে আহমদ) হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ভালোবেসে কখনও কখনও আমার নাম হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ: ২৪৭৪)

এছাড়াও অসংখ্য আন্তরিকতা ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিল নবীজির দাম্পত্য জীবন। একজন ভালো স্বামী হওয়ার জন্য বিশ্বনবী (স.)-এর আদর্শের চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে! তবে দাম্পত্য জীবনকে অর্থবহ করতে স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরও ব্যাপক ভূমিকা থাকা চাই। দুজনের ধৈর্যশীলতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে একটি সুখী পরিবার গড়ে ওঠে। আর সুখী পরিবারই আগামী প্রজন্মের আদর্শ বিদ্যাপীঠ।