পরিবার ও সমাজে ইসলামের সাম্যনীতি

পরিবার ও সমাজে ইসলামের সাম্যনীতি

প্রতিকী ছবি

মানুষ মহান আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। মানুষ কখন কোথায় জন্ম লাভ করবে, তা মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। মানুষের আকার-আকৃতি, ভাষা, গোত্র, বর্ণ—সবই আল্লাহ প্রদত্ত। এসবে মানুষের ইচ্ছার কোনো সুযোগ নেই।

কাজেই এসবের সঙ্গে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কোনো সম্পর্কও নেই। মানুষ হিসেবে সবাই সমান। মুক্ত ও স্বাভাবিক প্রকৃতি নিয়েই সব মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। এরপর আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের সুযোগ পায়।

পৃথিবীতে শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার কারণে বা ভাষা, গোত্র, বর্ণের কারণে কাউকে ভিন্নভাবে দেখা বা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। পরিবার ও সমাজে ইসলামের সাম্যনীতি নিম্নরূপ—

(১) মানুষ হিসেবে সবাই সমান : মহান আল্লাহ প্রথমে এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এরপর তাতে মানবজাতিকে পাঠিয়েছেন। প্রথমে আদম (আ.), এরপর হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করে তাঁদের মাধ্যমে অসংখ্য মানবের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন।

কাজেই সবাই তাঁদেরই সন্তান। মানুষ হিসেবে সবাই সমান। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তাঁর থেকে তাঁর সঙ্গিনীকে (হাওয়া) সৃষ্টি করেছেন আর বিস্তার করেছেন তাঁদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১) 

(২) ভাষা ও বর্ণের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই : বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, নারীর অধিকার ইত্যাদি আলোচনার পাশাপাশি ভাষা ও বর্ণবৈষম্য পরিহার করে সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে লোকসকল! জেনে রেখো, তোমাদের রব একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। জেনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের ওপরও অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কালোরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি তাকওয়া। আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছি? উপস্থিত সাহাবারা বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল! আপনি পৌঁছিয়েছেন।’

(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩৪৮৯)

(৩) ভালোবাসা প্রকাশে সমতা : ভালোবাসা অন্তরের বিষয় হলেও তা প্রকাশ করার পদ্ধতি মানুষের ইচ্ছাধীন। সন্তানদের মধ্যে ভালোবাসা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কমবেশি কাম্য নয়। মা-বাবার কথা ও কাজে এমন ভাব প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়, যাতে সন্তানরা বুঝতে পারে যে মা-বাবা অমুককে বেশি ভালোবাসেন বা অমুককে কম ভালোবাসেন। ইবনে জুরাইয থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) জনৈক আনসারি সাহাবিকে ডাকলেন। এরই মধ্যে ওই সাহাবির এক পুত্রসন্তান তাঁর কাছে এলো। তিনি তাকে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন এবং কোলে বসালেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর এক কন্যাসন্তান সেখানে উপস্থিত হলে তিনি তার হাত ধরে নিজের কাছে বসালেন। এটি লক্ষ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘উভয় সন্তানের প্রতি তোমার আচরণ অভিন্ন হওয়া উচিত ছিল। তোমরা নিজেদের সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো। এমনকি চুমু দেওয়ার ক্ষেত্রেও।’ (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৬৫০১)

(৪) সন্তানদের সম্পদ প্রদানে সমতা : সন্তানদের কোনো কিছু দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা জরুরি। স্নেহের আতিশয্যে কোনো সন্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ কাম্য নয়। আমের (রহ.) বলেন, আমি নুমান ইবনে বশীরকে (রা.) মিম্বারের ওপর বলতে শুনেছি যে আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাক্ষী রাখা ছাড়া আমি এতে সম্মত হবো না। তখন তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন এবং বললেন, আমি আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম দিয়েছ?’ তিনি বললেন, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তবে আল্লাহকে ভয় করো এবং আপন সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো।’ নুমান (রা.) বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে এসে সেই দানটি ফিরিয়ে নিলেন।

(বুখারি, হাদিস : ২৫৮৭) 

(৫) একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা : একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে অবশ্যই সমতা রক্ষা করতে হবে, অন্যথায় পরিবারে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি স্বামীকে পরকালে আল্লাহর কাজে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একজনের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ে আরেকজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে রেখো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১২৯) 

হাদিসে বলা হয়েছে—আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার দুজন স্ত্রী আছে, কিন্তু সে তাদের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, কিয়ামতের দিন সে এক অংশ অবশ অবস্থায় উঠবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৩৩)

(৬) উত্তরাধিকার ও অসিয়তে সমতা : মৃত্যুর সময় কোনো সন্তান বা উত্তরসূরিকে বেশি সম্পদ দেওয়ার অসিয়ত করে অন্যকে বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত করা এতটাই অন্যায়, যা জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া কোনো উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। মহান আল্লাহ কোরআন মাজিদে উত্তরাধিকার নীতিমালা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এখানে কমবেশি করার সুযোগ নেই। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোনো পুরুষ বা স্ত্রীলোক ৬০ বছর ধরে আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজ করে। অতঃপর তাদের মৃত্যু হাজির হলে তারা অসিয়াতের মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন নির্ধারিত হয়ে যায়। (তিরমিজি, হাদিস : ২১১৭; আবু দাউদ, হাদিস : ২৮৬৭) উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা বিষয়ে বলা হয়েছে—আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন জান্নাতের উত্তরাধিকার হওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন।’

(ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২৭০৩)

(৭) আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমতা : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নীতি সবার জন্য সমান। এ ক্ষেত্রে গোত্র, বর্ণ বা ভাষার কোনো প্রভাব নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অভিজাত পরিবারের এক নারীর চুরির অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। সবার অনুরোধে উসামা (রা.) তার ব্যাপারে নবী (সা.)-এর কাছে সুপারিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন নবী (সা.) কিছুটা রাগান্বিত হয়েছিলেন। এরপর মিম্বারে খুতবা দিয়ে বলেছিলেন—‘তোমাদের আগের সম্প্রদায়গুলো ধ্বংস হয়েছে, কারণ তারা নিম্নশ্রেণির লোকদের ওপর দণ্ডবিধি কার্যকর করত আর অভিজাত লোকদের অব্যাহতি দিত। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন, (আমার কন্যা) ফাতিমাও যদি এমন কাজ করত, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৭)
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়