আদর্শ জাতি গঠনে যুবশক্তির গুরুত্ব

আদর্শ জাতি গঠনে যুবশক্তির গুরুত্ব

প্রতিকী ছবি

তারুণ্য ও যৌবন মানুষের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। ইসলাম এটাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আখ্যা দিয়ে থাকে। তাই ইসলাম যৌবনকাল ও যুবসমাজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন,

কোনো একজন ব্যক্তিকে উপদেশস্বরূপ বলেন, পাঁচটি বস্তুর আগে পাঁচটি বস্তুকে গনিমত (মূল্যবান) মনে কোরো : ক. তোমার বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে, খ. পীড়িত হওয়ার আগে সুস্বাস্থ্যকে, গ. দারিদ্র্যতার আগে সচ্ছলতাকে, ঘ. ব্যস্ততার আগে অবসরকে, ঙ. মৃত্যুর আগে জীবনকে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৫১৭৪)
ইসলামে তারুণ্যের জয়গান

ইসলাম তারুণ্য ও যৌবনকে বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। কোরআন-হাদিসে তারুণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।

১. তারুণ্য আল্লাহর দান : তারুণ্য ও যৌবন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। তাই তারুণ্যের মূল্যায়ন করা এবং তার যথার্থ ব্যবহার আবশ্যক।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’
(সুরা : রোম, আয়াত : ৫৪)

২. জান্নাত কেবল তরুণদের জন্য : তারুণ্য ও যৌবন জান্নাতিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হাদিসের ভাষ্য মতে, জান্নাতে প্রবেশের সময় মানুষ চির তারুণ্য ও যৌবন লাভ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতিদের শরীরে কোনো পশম থাকবে না, দাড়ি-গোঁফ থাকবে না এবং চোখে সুরমা লাগানো থাকবে।

কখনো তাদের যৌবন শেষ হবে না, জামাও পুরনো হবে না।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫৩৯)

৩. সব নবীই ছিলেন যুবক : আল্লাহ দ্বিন প্রচারের গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন নবী-রাসুলদের। তাঁদের সবাই ছিলেন যুবক। বার্ধক্যে উপনীত কাউকে তিনি নবুয়তের দায়িত্ব দেননি। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ যুবক ছাড়া কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেননি।’ (আহাদিসুল মুখতারাহ : ১৬/১০)

৪. অন্যায়ের প্রতিবাদে নির্ভীক : তরুণ ও যুবকরা যুগে যুগে অন্যায়ের প্রতিবাদে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছে। পবিত্র কোরআনে এমন একদল যুবকের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম। আর আমি তাদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম, তারা যখন উঠে দাঁড়াল, তখন বলল, আমাদের প্রতিপালক আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক। আমরা কখনই তাঁর পরিবর্তে অন্য কোনো ইলাহকে আহ্বান করব না; যদি করে বসি, তবে তা অতিশয় গর্হিত হবে।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৩-১৪)

৫. যুবক জাতির বিবেক জাগায় : মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘ইবরাহিম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৪)

পবিত্র কোরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর যেসব গুণ বর্ণিত হয়েছে তার একটি হলো স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমগ্র জাতির বিবেক জাগিয়ে দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ কেউ বলল, এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি, তাকে বলা হয় ইবরাহিম। তারা বলল, তাকে উপস্থিত করো লোকসম্মুখে, যাতে তারা প্রত্যক্ষ করতে পারে। তারা বলল, হে ইবরাহিম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এইরূপ করেছ? যে বলল, বরং তাদের এই প্রধান, সে-ই তো এটা করেছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো যদি তারা কথা বলতে পারে। তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল, তোমরাই তো সীমা লঙ্ঘনকারী?’
(সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৬০-৬৪)

পৃথিবীর প্রথম আত্মত্যাগ যুবকের

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম অন্যায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন হাবিল। কাবিল তাঁকে হিংসার বশবর্তী হয়ে হত্যা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের থেকে (কোরবানি) কবুল করে থাকেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তবে আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা আমি জগত্গুলোর প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২৭-২৮)

সত্যের আহ্বানে যুবকদের ত্বরিত সাড়া

মহানবী (সা.) যখন মহাসত্যের আহ্বান নিয়ে আসেন, তখন মক্কার যুবকরাই সর্বপ্রথম সাড়া দেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়সে যুবক। যেমন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আবু বকর (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৭ বছর, উসমান (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৪ বছর, ওমর (রা.)-এর বয়স ছিল ২৭ বছর, আলী (রা.)-এর বয়স ছিল ১০ বছর। (আলুকা ডটকম)

নবী (সা.)-এর যুগে রাষ্ট্রীয় কাজে যুবকদের অংশগ্রহণ

রাসুলুল্লাহ (সা.) যুবক ও তরুণদের মেধা, যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার মূল্যায়ন করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় তরুণ ও যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। যেমন ইফকের মতো গুরুতর বিষয়ে তিনি উসামা বিন জায়েদ (রা.)-এর মতো কিশোরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাকে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রেরিত বাহিনীর সেনানায়ক নিযুক্ত করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৬৯)

আত্তাব ইবনে উসাইদ (রা.)-কে মক্কার গভর্নর নিযুক্ত করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৮৯)

মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে মদিনায় শিক্ষক ও ইসলাম প্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-১৬০)

এ ছাড়া আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে ইয়েমেনের প্রশাসক এবং উসমান ইবনে আবিল আস (রা.)-কে তায়েফের প্রশাসক নিযুক্ত করেন।  উসমান ইবনে আবিল আস (রা.)-এর প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি এই তরুণের মধ্যে কোরআন শিক্ষা ও ইসলামের গভীর জ্ঞানার্জনে অত্যন্ত আগ্রহী পেয়েছি।’ (কালের কণ্ঠ : ০৫-০১-২০২০)

যুবক হত্যাকারীদের প্রতি অভিশাপ

বিরে মাউনার হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই ঘটনায় ৭০ জন যুবক আনসার সাহাবিকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। যারা ছিল কোরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত। মহানবী (সা.) এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং হত্যাকারীদের প্রতি ধারাবাহিকভাবে অভিশাপ করেন। তিনি ১৫ দিন (মতান্তরে এক মাস) পর্যন্ত প্রতিদিন ফজরের নামাজে তাদের প্রতি অভিশাপ করেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৩৩৯৬)

শৃঙ্খলা তারুণ্যের সৌন্দর্য

তরুণ ও যুবকদের কাজের সৌন্দর্য শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা থাকলে তাদের কাজ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়। মালিক বিন হুওয়াইরিস (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, তাঁরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসেন। তাঁরা সেখানে ২০ রাত অবস্থান করেন। তিনি তাঁদেরকে দ্বিনের মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দান করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে দ্বিনপ্রচারের নির্দেশ দেন এবং দ্বিনি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নামাজের সময় হলে তোমাদের একজন আজান দেবে। তবে বয়সে যে সবার বড় সে ইমামতি করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪২১)

তরুণদের গড়ে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

ইসলাম তরুণদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা তরুণদের শিক্ষাদীক্ষায় অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কোনো মুসলিম যুবককে দেখলে খুশি হয়ে বলতেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার এবং তোমাদের হাদিস বোঝাবার  নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও হাদিসের ধারক তথা ইলমের উত্তরাধিকারী।’

(শরফু আসহাবিল হাদিস, পৃষ্ঠা-১২)

যৌবনকালের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ

ইসলাম যেমন তারুণ্য ও যৌবনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি পরকালেও যৌবনের ব্যাপারে তাদের বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মহানবী (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মানুষকে নিজ স্থান থেকে এক কদম নড়তে দেওয়া হবে না। তাহলো—১. সে তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, ২. যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে, ৩. ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪. কোন পথে তা ব্যয় করেছে, ৫. সে দ্বিনের কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৭)