নামাজির পেছনে লেগে থাকা শয়তানের নাম কী

নামাজির পেছনে লেগে থাকা শয়তানের নাম কী

ছবি: সংগৃহীত

শয়তান মহান আল্লাহর সামনে মানবজাতিকে সত্যচ্যুত করার অঙ্গীকার করেছিল। আল্লাহ তাআলাকে সে বলেছিল ‘আমি অবশ্যই আপনার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেবো।’ (সুরা নিসা: ১১৮)

মুমিনের নামাজ নষ্ট করা শয়তানের অন্যতম মিশন। কারণ নামাজ এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর খুব কাছাকাছি চলে যায়; গুনাহমুক্ত হয়ে যায়; অতঃপর জান্নাতের অধিকারী হওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা নামাজের হেফাজত করে, তারাই সম্মানিত হবে জান্নাতে।’ (সুরা মাআরিজ: ৩৪-৩৫)

যে শ্রেণির শয়তান নামাজ ও কেরাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং নামাজির মনে সংশয় তৈরি করে, তারা হলো খিনজাব শ্রেণির শয়তান। উসমান বিন আবিল আস (রা.) বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, শয়তান আমার নামাজ ও কেরাতের মাঝে এসে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং আমার মনে সংশয় সৃষ্টি করে। নবী কারিম (স.) বললেন, এটি খিনজাব নামক শয়তানের কাজ। যখন তুমি এর প্রভাব অনুভব করবে, তখন আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে এবং বাম দিকে তিনবার থুথু ফেলবে। আমি তাই করলাম এবং আল্লাহ তাআলা তাকে আমার থেকে বিতাড়িত করলেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২২০৩)

শয়তানের খিনজাব শ্রেণিটি ইকামত শেষ হলে আসে এবং তার শয়তানি শুরু করে। নামাজিদের অমনোযোগী করার চেষ্টা করে। মুসল্লির মনে বিভিন্ন দুনিয়াবি চিন্তা প্রবেশ করিয়ে দেয়। ফলে নামাজে মুসল্লির মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন নামাজের জন্য আজান দেওয়া হয়, তখন শয়তান হাওয়া ছেড়ে পলায়ন করে, যাতে সে আজানের শব্দ না শোনে। যখন আজান শেষ হয়ে যায়, তখন সে আবার ফিরে আসে। আবার যখন নামাজের জন্য ইকামত বলা হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইকামত শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে এসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং বলে এটা স্মরণ করো, ওটা স্মরণ করো, বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পোঁছে যে, সে কয় রাকাত নামাজ আদায় করেছে তা মনে করতে পারে না। (বুখারি: ৬০৮)

এই শ্রেণির শয়তানকে কোনো বর্ণনায় ওয়ালহান নামে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) উল্লেখ করেছেন, শয়তানের নয়টা শ্রেণি আছে- ১. ‘জালিতুন’ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ২. ‘ওয়াসিন’ মানুষকে আকস্মিক বিপদে ফেলার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। ৩. ‘লাকুস’ অগ্নি পূজারিদের সঙ্গে থাকে। ৪. ‘আওয়ান’ শাসকদের সঙ্গে থাকে। ৫. ‘হাফফাপ’ মদ্যপায়ীদের সঙ্গে থাকে। ৬. ‘মুররাহ’ গান-বাজনাকারীদের সঙ্গে থাকে। ৭. ‘মুসাব্বিত’ বাজে কথাবার্তা সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে। ৮. ‘দাসিম’ ঘরের মানুষদের ভালো কাজ থেকে বিরত ও খারাপ কাজের আদেশ দেয়। ৯. ‘ওয়ালহান’ অজু, নামাজ ও অন্য ইবাদতে কুমন্ত্রণা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে। (আল মুনাব্বিহাত, পৃষ্ঠা-৯১)

খিনজাব বা ওয়ালহান শ্রেণির শয়তানের মোকাবেলা করতে না পারলে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তারা কুমন্ত্রণা দিয়ে নামাজির মনে উদাসীনতা এনে দেয়। নামাজে উদাসীনতা বলতে যথাসময়ে নামাজ আদায় না করা, যখন মন চায় তখন পড়া, নম্র ও একাগ্রতার সঙ্গে নামাজ না পড়া অথবা মোটেই না পড়াকে বোঝানো হয়েছে। যা একজন মুমিনকে ধ্বংস করে দেয়। পবিত্র কোরআনে সেসব নামাজির ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন, কাজেই দুর্ভোগ সে নামাজ আদায়কারীদের, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে উদাসীন। (সুরা মাউন: ৪-৫)

শয়তান কখনো নামাজির মনে অহংকার, লৌকিকতা এনে নামাজির নামাজ ছিনতাই করে। তখন লোক দেখানো উদ্দেশ্য হওয়ার কারণে সেই নামাজ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়াকে মুনাফিকদের কাজ বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ‘যখন তারা (মুনাফিকরা) নামাজে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সঙ্গে, শুধু লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে থাকে।’ (সুরা নিসা: ১৪২)

শয়তান থেকে দূরে থাকতে, তার ধোঁকা থেকে বাঁচতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেছেন এভাবে— ‘শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো।’ (সুরা ফাতির: ৬) শয়তানের মোকাবেলায় এমন মহাশক্তির কাছে প্রার্থনা করতে হবে, যিনি তার লাগাম ধরে টান দিতে সক্ষম, তার চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে সক্ষম। তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে তুমি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করো, তবে আল্লাহর শরণাপন্ন হও। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা হা-মিম সাজদাহ: ৩৬)

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন, হে আমার রব! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি শয়তানদের সব অমঙ্গল ও অনিষ্টতা থেকে।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৭)

শয়তানের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকতে নবী কারিম (স.) সাহাবাদেরকে বিভিন্ন আমল ও দোয়া শিখিয়েছেন। একটি দোয়া হলো- لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদির। অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই, রাজত্ব একমাত্র তারই, সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র তারই জন্য, আর তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সহিহ বুখারি: ৩২৯৩)

সারাদিন শয়তান থেকে নিরাপদ থাকতে কার্যকরী আরেকটি দোয়া হচ্ছে— أَعُوذُ بِاللهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ‘আউজুবিল্লাহিল আজিম ওয়া বিওয়াজহিল কারিম ওয়া সুলত্বানিহিল কাদিমি মিনাশ শাইত্বানির রাঝিম।’ অর্থ: ‘আমি মহান আল্লাহর কাছে; তাঁর মহানুভব চেহারার কাছে; তাঁর অনাদি-অনন্ত কর্তৃত্বের কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মুসনাদে আহমদ, বুখারি ও মুসলিম)

আল্লাহ তালা আমাদের সবাইকে শয়তানের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন। যথাযথভাবে নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।