দরিদ্রদের খাদ্যের সঙ্গে নগদ টাকাও দিতে হবে

দরিদ্রদের খাদ্যের সঙ্গে নগদ টাকাও দিতে হবে

ছবিঃ সংগ্রহীত

করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে টানা সাধারণ ছুটিতে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা এখন চরমে। বিশেষ করে রিক্সাওয়ালা, হকার কিংবা সরকারের ট্রেড লাইসেন্স ও শ্রম আইনের অধীনে নেই এরকম অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কয়েক কোটি শ্রমজীবী এখন ভবিষ্যত নিয়ে অন্ধকারে।

এসব শ্রমজীবী কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেহেতু সরাসরি সরকারি আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নেই আবার শ্রম আইনের বাইরে থাকায় পেনশন কিংবা ন্যুনতম ক্ষতিপূরণের সুযোগও নেই।

ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে করোনা পরিস্থিতিতে আয় হারিয়ে এসব মানুষ এখন টিকে আছেন কিভাবে?

তিন বছর আগে অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার একটি ব্যবসা শুরু করেন সামিয়া আফরোজ।

এবারের পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে আয় এবং ব্যবসা দুটোই বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এক মাস আগেই ব্যবসার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় তাকে।

সামিয়া আফরোজ জানাচ্ছেন, নিজে তো আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেনই একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী পাঁচজনও পড়েছেন ক্ষতিতে।

সামিয়া আফরোজ বলছেন, "বৈশাখ এবং ঈদে আমরা ব্যবসা তো করতে পারলামই না, এখন আমাদের পরিবারই আর্থিকভাবে হুমকির মধ্যে। আমার কর্মীদের আমি গত মাসের বেতন দিয়েছি। সামনের মাসে দিতে পারবো কি-না, জানি না। এমনকি তাদেরকে চাকরীতে রাখবো না ছেড়ে দেবো সেটাও বুঝতে পারছি না। এখন তাদের অবস্থা তো আরো খারাপ।"

সামিয়া আফরোজ সমস্যা দেখছেন, ভবিষ্যতে নতুন করে ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রেও। কারণ তার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ব্যবসায়ীরা সেভাবে সরকারি প্রণোদনার আওতায় নেই।

কিন্তু গাড়ি চালক জহুরুল অবশ্য এখনি অতো দূরের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারছেন না।

একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপে অন্যের গাড়িয়ে চালিয়ে অর্থ উপার্জন করা জহুরুল বর্তমান সময়ে কিভাবে জীবন চালাবেন তা নিয়েই দু:শ্চিন্তায়। জহিরুল বলছিলেন,

"আমি আরেকজনের গাড়ি চালাইতাম।

কোম্পানির বিল, গ্যাসের খরচ বাদে যা থাকতো তার ৪০ শতাংশ টাকা মালিক আমাকে দিতো। এখন জিরো। কোন বাসা বাড়িতেও ড্রাইভার নেয় না। নিবে কি, ঢুকতেই তো দেয় না।"

জহিরুল বলছেন, এখনো তিনি বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি। ধার-দেনা করে আপাতত: চলছেন।

পরে কী হবে তা বুঝতে পারছেন না।বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই আছে যারা এখনো তাদের কর্মীদের বেতন দেয়নি। তারাও রয়েছেন বিপদে।

ঢাকার একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন এরকম একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, তারা গত মার্চ মাসের বেতন পাননি।

এমনকি মার্চের শেষ দিকে যখন পার্লার বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার টাকা ধার নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন তিনি।

চলতি মাসেও বেতন পাবেন কি-না, না পেলে কীভাবে সংসার চালাবেন তা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় আছেন তিনি।

অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবীদের জরুরী সাহায্য কেন দরকার?
বাংলাদেশে রিক্সাওয়ালা, হকার থেকে শুরু করে দিনমজুর সকলেই আসলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভূক্ত।

আবার যারা মাসভিত্তিক বেতন পান এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন যেগুলো সরকারের ট্রেড লাইসেন্স কিংবা শ্রম আইনের অধীনে নয়, তারাও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অংশ।

এ ধরণের কর্মজীবীদের কোন নোটিশ ছাড়াই চাকরীচ্যুত করা যায়, ন্যুনতম ক্ষতিপূরণ নেই, বীমা নেই, পেনশন নেই।

অথচ এ ধরণের শ্রমজীবীর সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লক্ষেরও বেশি। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫.১ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি'র নির্বাহী পারিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, বাংলাদেশে শ্রমজীবীরা মূলত: অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই বেশি এবং করোনা ভাইরাসের কারণে এখন যে পরিস্থিতি তাতে করে বিশাল আকারের এই শ্রমজীবীদের প্রতি আলাদা করে নজর না দিলে তা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলবে।তিনি বলছেন, "অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকদের কিন্তু চাকরীর কোন নিশ্চয়তা নেই, বেতনেরও নিশ্চয়তা নেই। অতি দরিদ্র, দরিদ্র এমনকি দারিদ্রসীমার উপরে যারা স্বল্প আয়ের লোক তাদেরও কিন্তু সহযোগীতার প্রয়োজন পড়ছে। কারণ অনেকেরই কিন্তু আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।"

"সবচেয়ে বড় বিপদটা হলো যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত স্বল্প আয়ের লোক তাদের চাওয়ারও কোন জায়গা নেই। এই জনগোষ্ঠীকে কিন্তু আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সময় এখন। তাদেরকে বাইরে রেখে আমরা অর্থনীতির এই সংকটকে মোকাবেলা করতে পারবো না।"সরকার কী করছে?
কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল আকারের এক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, বয়স্ক ভাতা কিংবা এ ধরণের কর্মসূচির আওতায় এসব মানুষকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১০টাকা কেজি চাল কর্মসূচিও আছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলছেন, কাজ কিংবা উপার্জন হারানো মানুষের জন্য এখন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই বড় ভরসা।

এসব মানুষকে সরকারের সহায়তার অন্তর্ভূক্ত হতে হবে।

তবে সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, সরকার যে তালিকা ধরে ত্রাণ কিংবা সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে আসছে সেই তালিকায় স্বচ্ছতা আনতে হবে সবার আগে। এক্ষেত্রে বেসরকারি এনজিও, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

তিনি বলছেন, "অনেক কথা বলা হয়েছে শ্রমিকদের বিনামূল্যে খাদ্য দেয়া হবে, ১০ টাকায় চাল দেয়া হবে ইত্যাদি। কিন্তু এর জন্য কত টাকা দেয়া হবে, বরাদ্দ কত সে বিষয়ে কিন্তু সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই।"

"এখানে একটা প্যাকেজ করতে হবে। অর্থাৎ খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে নগদ অর্থও দিতে হবে। যেনো তারা খাদ্য বহির্ভূত প্রয়োজনগুলোও মেটাতে পারে। আর তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম বাদ দিয়ে বড় তালিকা করতে হবে।"

বাংলাদেশে এমনিতেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি। এর সঙ্গে করোনা পরিস্থিতিতে কাজ কিংবা আয় হারিয়ে হঠাৎ করেই দারিদ্রের কবলে পড়েছেন আরো অসংখ্য মানুষ।

এসব মানুষের সহায়তায় আগে থেকেই সরকারের উদ্যোগ আছে ঠিকই কিন্তু সেই উদ্যোগের আওতা এখন কিভাবে বাড়ানো হয় তার উপরই নির্ভর করছে হঠাৎ করে উপার্জন হারানো মানুষেরা এতে করে কতটা উপকার পাবেন সেটা।বিবিসি