পাবনার লিচু চাষীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ

পাবনার লিচু চাষীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ

পাবনা প্রতিনিধি

করোনাভাইরাসের কারণে পাবনার লিচু চাষীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। স্বাভাবিকের দিকে তাকিয়ে আছেন হতাশাগ্রস্থ লিচু চাষিরা। ফিরে আসুক স্বাভাবিক অবস্থা, শুরু  হোক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই আশায় বুক বেধে আছেন লিচু চাষিরা।

কয়েক বছর ধরে লিচু প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেছে পাবনা। পাবনা অঞ্চলের লিচুর চাহিদা রয়েছে এখন  দেশ জুড়ে। দিনাজপুরের লিচুর সাথে পাল্লা দিয়ে পাবনার লিচু ঢেউ খাচ্ছে  দেশের সর্বত্রে। বিশেষ করে ঈশ্বরদীর  লিচু দিনাজপুরকে পিছনে ফেলেছে। কারণ  গোটা ঈশ্বরদীর মাটি লিচু আবাদের জন্য খুবইউর্বর। এখানের মাঠি বেলে ও দোঁআশ। যা লিচু আবাদের জন্য শতভাগ উপযোগী। সব জাতীয় লিচুই এখানে অল্প সময়ে পরিপক্ষ হয়ে যায়। বললেন, কৃষি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। তাই দেশের দূরদূরান্তের লিচু ব্যবসায়ীরা দিনাজপুরের পরিবর্তে ঈশ্বরদীর দিকে ঝোঁক বেশি দেখা যায়।

এ বছর জেলার বিভিন্ন বাগানের প্রায় ৮০/৮৫ ভাগ গাছে লিচু ধরেছে। এবার আবহাওয়া অনুকূল থাকায় বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবছর গাছে প্রচুর পরিমানলিচু ধরেছে। ফলে লিচু আবাদকারী কৃষকরাও বেশ উৎফুল্ল। কিন্তু বাধ সেঁঝেছে মরণঘাতী করোনাভাইরাস। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে আছে। তাইদুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে লিচু কৃষকের। দাম বেশি ও ফলন ভালো হওয়ায় এ অঞ্চলের শত শত অন্যান্য আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে লিচু আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন। অনেকে আছেন এ লিচু থেকে উপার্জিত অর্থই তাদের গোটা বছর চলে। কিন্তু এবার তারা খুবই অসহায়ত্ববোধ করছেন বিদ্যমান এ করোনাভাইরানের কারণে।

যাই হোক দেশীয় জাতের কিছু কিছু লিচু বাজারে ওঠলেও সপ্তাহখানেক অথবা ১০/১২ দিন পরেই বা ঈদের মধ্যেই মোজাফফরপুরী জাতের লিচু বাজারে ওঠবে। এর ১৫ দিন পরেই পাকা শুরু হবে উন্নত জাতের বোম্বাই ও চায়না-৩ জাতের লিচু। কিন্তু করোনার কারণে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে লিচু কেনার জন্য বাইরের কোন ব্যাপারী (ব্যবসায়ী) আসেননি। এলাকার লিচু ব্যবসায়রাও বাগান কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। তাই পাবনা অঞ্চলে লিচু চাষী ও বাগান মালিকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় না আসলে লিচু নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে লিচু চাষী ও ব্যবসায়ীদের। বড় ধরণের লোকসান গুনতে হতে পারে এ অঞ্চলের লিচু চাষীদের। বিগত কয়েক বছর ধরেই পাবনা অঞ্চল থেকে প্রায় ৫ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয়ে আসছে। চাষী এবং ব্যবসায়ীরা এখন শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থণা করছেন করোনা দূর হয়ে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক।

এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে লিচু বিক্রির কথা বলা হলেও এই বিষয়ে গ্রামের সাধারণ কৃষকদের মধ্যে এই ধরণের সুযোগ সুবিধা ততটা নেই বলে জানান কৃষকরা। এছাড়াও এই অনলাইনে বিপুল পরিমান লিচু বিক্রয় সম্ভবনা বলে তারা মনে করেন।

লিচু চাষীরা জানান, লিচু চাষের জন্য অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পাবনা অঞ্চলে লিচুর ভালো ফলন হয়ে থাকে। এঅঞ্চলে সাধারণত দেশী (মোজাফফরপুরী), বোম্বাই ও চায়না-৩ জাতের লিচুর বাগান রয়েছে। পাবনার লিচু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। বিগত বছরগুলোরে লিচু গাছে মুকুল আসা থেকে শুরু করে পাকা শুরু হওয়া পর্যন্ত কয়েক দফায় বাগান বিক্রি হয়ে থাকতো। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা বাগান কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী বাগান কিনলেও তারা খুবই চিন্তিত। এক কথাই জেলার বাইরের কোন ব্যবসায়ীই এখন পর্যন্ত বাগানে আসেননি। বিগত বছরে এই সময়ে একটি বাগান কয়েক হাত বদল হয়েছে।

পাবনা জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলাব্যাপী অর্থাৎ নয় উপজেলায় ৪,৬০০ ( চার হাজার ছয়শ’) হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করছেন চাষীরা। যা গতবারের চেয়ে প্রায় ৪শ’ হেক্টর জমিতে বেশি লিচু আবাদ করছেন কৃষকেরা। লিচু আবাদি বাগান ছাড়াও জেলার বিভিন্ন গ্রামের অনেক বাড়ীর আঙ্গীণায় ২/৪টি করে লিচু গাছ রয়েছে। এর মধ্যে জেলার ঈশ^রদী ও সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লিচু বাগান রয়েছে।

জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রুপপুর, ভারইমারি, জয়নগর, আওতাপাড়া, পাকশী, বক্তারপুর ও দাশুড়িয়া, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, উগ্রগড়, মধুপুর, মৌগ্রাম, জোয়ারদহ, শালাইপুর, গয়েশপুর, জালালপুর ও মালঞ্চিসহ বিভিন্ন গ্রামে শত শত লিচুর বাগান রয়েছে। এসব বাগানের গাছগুলোতে এখন লিচু ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। লিচুর আকারও বেশ বড় হয়েছে।

এদিকে এসব এলাকার লিচু চাষী বাগান পরিচর্যা এবং পাহারা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু ব্যাবসায়ীদের আনাগোনা নেই। বিগত বছরগুলোতে এই সময় এসব অঞ্চলের বাগানে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার লিচু ব্যবসায়ীরা এসে বাগান কিনে থাকতেন।

বাগান মালিকরা জানান, আমাদের সারা বছরের অর্থনৈতিক চাকা নির্ভর করে এই লিচু বাগানের উপর। অনেক কৃষক তাদের অন্যান্য ফসলি জমিতে এখন লিচু বাগান তৈরি করেছেন অর্থনৈতিক লাভের আসায়। কিন্তু এবছর তাদের মাথায় হাত। তারা জানান, শুধু বাগান মালিকরাই নয়, এই লিচুর মৌসুমে অনেক দিন মজুর কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হতে বসেছে এবছর।  

এসব এলাকার লিচু চাষী হবিবর রহমান, তোরাপ আলী, আরশেদ আলী, হালিম খান, মানিক, আব্দুল কাদের, শহিদ শেখ, আজিজল মল্লিক, আয়েজ উদ্দিনসহ অনেক লিচু চাষী ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হয়।

লিচু চাষীরা জানান, পাবনা অঞ্চলে বোম্বাই, চায়না-৩, মোজাফফরপুরী দেশী জাতের লিচু আবাদ হচ্ছে। দেশী জাতের লিচু আকারে ছোট। পাকা শুরু হয় উন্নত জাতের লিচুর চেয়ে ১৫-২০ দিন আগে। এরফলে চাষীরা ভালো দাম পেয়ে থাকেন। এছাড়াও অল্প দিনেই লিচু পাকার কারণে বাগানে কম সময় শ্রম দিতে হয়। বেশী দিন রাত জেগে পাহারা দিতে হয় না। তবে এ বছর তারা লিচু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

পাবনা সদর উপজেলার চকউগ্রগড় গ্রামের লিচু চাষী হারুন-অর রশিদ জানান, এ বছর তার বাগানের প্রায় ৭৫ ভাগ গাছে লিচু ধরেছে। করোনার কারণে লিচু বিক্রি নিয়ে খুবই চিন্তিত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তার বাগানে কোন ব্যাপারী আসেননি।

পাবনা সদর উপজেলার জোয়ারদহ গ্রামের আদর্শ কৃষক আব্দুল লতিফ জানান, জেলার প্রায় ৮০ ভাগ গাছে লিচু আছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি কমতে শুরু করলে হয়তো ভালো দাম পাওয়া যাবে। তবে এখন পর্যন্ত লিচু বিক্রি নিয়ে আমরা চিন্তিত। আসা করছি এঅঞ্চলের লিচু চাষীরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে দিকে সরকার দৃষ্টি রাখবেন।

জাতীয় ফল ও বৃক্ষ পুরষ্কার ও সনদপ্রাপ্ত ঈশ্বরদী উপজেলার লিচু চাষী আব্দুল জলিল কিতাব মন্ডল বলেন, এবছর পাবনা জেলায় লিচুর ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে লিচু পাকতে শুরু করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা বাগান কিনছেন না। আগে থেকে যারা দু’একটি বাগান কিনেছেন তারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সরকার যে ভাবে ধান কাটার জন্য ব্যবস্থা করেছেন। সেভাবে লিচু বিক্রির জন্য কোন ব্যবস্থা করে দিলে লিচু চাষিরা উপকৃত হবেন।

পাবনা সদর উপজেলার লিচু ব্যাবসায়ী আমনগীর হোসেন জানান, করোনার কারনে লিচু বাগান কিনতে ভরসা পাচ্ছি না। লকডাউন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে লিচু বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়তে হতে পারে। এছাড়া জেলার বাইরের কোন ব্যবসায়ী এখন পর্যন্ত এলাকায় আসেনি। তাই এই মুহুর্তে বাগান কিনতে সাহস পাচ্ছি না।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজাহার আলী জানান, লিচু বাগান মালিকরা তাদের লিচু অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবেন। এ জন্য বাগান মালিকগণ জেলা ও উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে তাদেরকে অনলাইন ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে দেওয়া ব্যবস্থা করা হবে। আশা করছি লিচু নিয়ে কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হবে না।

পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, এ বিষয়ে আমরা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে আগেই আলোচনা করেছি। আস্তে আস্তে বাজারও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এতে আশা করা যায় লিচু নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে না। তবে বাস্তবতার আলোকে এবার শুধু ঢাকা কেন্দ্রীক না হয়ে পাবনা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় লিচু সরবরাহ করার চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়াও পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ভালোর দিকে। আর প্রযুক্তি তো আছেই।