বাবা তুমিই শ্রেষ্ঠ

বাবা তুমিই শ্রেষ্ঠ

আবু জাফর

এই গ্রহে বছরের প্রায় সব দিনই কোন দিবস, কোন উৎসব থাকে। এগুলোর কিছু সামাজিক, কিছু অর্থনৈতিক আবার কিছু সচেতনতামূলক। কিন্তু মা-বাবা দিবস গুলো এর থেকে ভিন্ন। এখন আষাঢ় মাস, ঘরের চালে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ভাবান্তর হলো; চাল যে রকম ঝড়-তুফান, রোদ-বৃষ্টি থেকে তার অধিবাসীকে রক্ষা করে, ঠিক তদ্রুপ এই জগত সংসারের সমস্ত কষ্ট-ক্লেশ-ব্যাথা নিজের উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে বাবা পরিবারকে দিয়ে যায় নিরাপত্তা আর শান্তি।

বাবা আমার মাস্টার মানুষ; কারনে-অকারণে মুখ দিয়ে ফুটে মিষ্টি কথার ফুলঝুরি কখনো আবার ঝড়ে অগ্নিশর্মা চোখের অগ্নি। তার কাছ থেকেই শিখেছি কারো হৃদয়ে জায়গা করার জন্য বেশ টাকা-পয়সা বা যশ-খ্যাতির দরকার হয় না।

 একটু সততার সাথে মিষ্টি কয়েকটা বুলিই দুনিয়ার মানুষ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। আব্বুর বহু গুনগ্রাহীর ভীড়ে আমি নেহাতেই ছোট্ট একটা মানুষ। তাই মুখ ফুটে কখনো মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে পারিনি। তবে ছোটবেলায় সবার মত আমারও ধারণা ছিল, তিনি আমাকে ভালোবাসেন না, যেমনটি আমার ভাইদের ভালোবাসে। কিন্তু এসব ধারনা গুলো তাসের ঘরের মত ভেঙে গিয়েছিল আজ থেকে ছয় বছর আগেই। একটু খুলে বলি, তখন আমাকে তিনি প্রথম দূরে এক মাদরাসায় ভর্তি করাতে নিয়ে যান।

যেদিন তিনি ভাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দেন, দেখলাম হঠাৎই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি, আর বলতেছিলেন ভাইকে, "একটু দেইখা রাইখো, আমার খুব আদরের ছেলে কোনদিন মা-বাবা ছাড়া থাকেনি।" আমি অপলকভাবে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন, আমার জন্যই তিনি কাঁদছেন! তাহলে এতদিনের ধারণা গুলো কি আসলেই ভুল ছিল, সেদিন খুব অনুতপ্ত হয়েছিলাম। দুরন্ত শৈশবে যা যা করার সব আমি করেছি, কখনো এক টাকার জন্য বাড়ি ঘরের জিনিস ভেঙ্গে ফেলা কখনো টিউবওয়েলের মাঝে মরিচের গুড়ো দেয়া আর কত কি!

 আর তাতেই নিয়ম করে সকাল-বিকাল বাবা পিটুনি খেতাম। কেমন যেন মা'র না খেলে শরীরটা জ্বালা করতো, তবে মাঝেমধ্যে যখন বেড়ধর পিটুনিটা একটু লাগতো। তাই একরকম খুশিই হয়েছিলাম দূরে যেয়ে, কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই বুঝিছিলাম এই আবদ্ধ জায়গা থেকে আমার বাবার পিটুনিই ভালো ছিল। বাবার মায়াভরা মনের উপর যে পাতলা শাসনের আবরন ছিল তখন তা বুঝেছি। কারন পিটুনির পরেই বাবা খুব আত্মপীড়ায় ভুগতো। এখন সে লাইনটা বার-বার মনে পড়ছে শাজাহান নাটকের সম্রাট শাজাহান বলেছিলেন " পিতা যখন পুত্রকে শাসন করে, পুত্র ভাবে পিতা কি নিষ্ঠুর কিন্তু সে জানে না, পিতার উদ্যত বেতের অর্ধেক খানি পড়ে সে পিতার পৃষ্ঠেই"।

কার্যত পুরো বংশের মাঝে তিনি মাননীয়। আমার ছয় চাচা ও দুই ফুফুরা যে কোন ব্যাপারে, যে কোন সময় আব্বুর সাথে পরামর্শ করে। যার যেকোন সমস্যা চলে আসে বাবার কানে, বাবাও দিন-দুনিয়া এক করে লেগে যান সমাধান করতে। তখন নিজ পরিবারের কথাও ভাবার তেমন সময় থাকে না। যে কিনা পুরো বংশের সাহসের উৎস ছিলো, খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সামলে নিতো সব পরিস্থিতি, সে বাবাই এই ঈদের পর একটু জ্বরে কাবু হয়ে গেলো। আর করোনার কথা শুনলেই তার মুখটা শুকিয়ে যেত। লোকে বলে, "যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়"।

তার করোনা টেস্ট পজিটিভ এলো। বাড়ি সহ লকডাউন হলো। ব্যস্ত বাবার সাথে পরিবারের সবাই এই প্রথম এতদিন একই ঘরে থাকছি। তাই প্রতিনিয়তই নতুন করে আবিষ্কার করছি প্রিয় জনক কে। আশা করি মালিক তাকে সুস্থ করে দিবেন। চারিদিকে প্রিয়জন হারানোর মিছিলে যেন আমার বাবাও চলে না যায়, এবারের বাবা দিবসে সবার কাছে এই দোয়াই চাই।

 আবু জাফর : শিক্ষার্থী,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ।