করোনা পরীক্ষায় জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় প্রতারকদের দমনে কঠোর হতে হবে

করোনা পরীক্ষায় জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় প্রতারকদের দমনে কঠোর হতে হবে

ফাইল ফটো

বিশ্বময় করোনার কাছে সব পদক্ষেপই ব্যর্থতায় পর্যবশিত হচ্ছে। তবুও থেমে নেই প্রতিরোধের নতুন নতুন ধ্যনধারণা ও পদক্ষেপ। সারা বিশ্বে মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা থমকে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতিসহ নানা ধরণের অনিশ্চিয়তা। আর এ অবস্থার মধ্যে যদি করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রতারণার ঘটনা ঘটে; তবে তা কতটা ঘৃণ্য ও ভয়ংকর বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

 বেশ কিছুদিন ধরে করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন জায়গায় অনিয়মের খবরাখবর পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দেয়ায় ও মেয়াদপূর্তিও পরেও লাইসেন্স নবায়ন না করায় রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা এবং মিরপুর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, অনিয়মের সত্যতা মেডিকেল প্র্যাক্টিস্, প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ল্যাবরেটরি রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ওই হাসপাতালের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেয়া জয়েছে। একই ধরণের অনিয়ম পাবনার ঈশ্বরদীতে একটি ক্লিনিকেও ঘটেছে মর্মে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই ক্লিনিকের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বলা দরকার, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর পরই গত মার্চে রিজেন্ট হাসপাতালকে  কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করেছিল সরকার। কিন্তু কোভিড-১৯  নমুনা পরীক্ষার জাল সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগ পেয়ে সোমবার উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেনন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে র‌্যাব অভিযান চালায়। আর সেখানেই অনুমোদনহীন টেস্ট কীট ও ভুয়া রিপোর্ট পাওয়ার পর ওই হাসপাতাল ও রিজেন্ট কার্যালয়  সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। যেখানে সারা বিশ্বের মানুষ করোনার কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। একের পর এক বাড়ছে লাশের সংখ্যা। সেই করোনা নিয়ে প্রতারণা করলে তা কতটা ঘৃণ্য হতে পাওে  সেটা বর্ণনাতীত। সঙ্গত কারনেই এ ঘটনা আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই।

শুধু রিজেন্ট হাসপাতালই নয়; এর আগে বাসায় গিয়ে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ এবং সেই নমুনার কোন পরীক্ষা ছাড়ায় একদিন পরেই ফলাফল দেয়া হতো। এমন অভিযোগ ওঠে জবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থসেবার  (জেকেজি হেলথকেয়ার)  বিরুদ্ধে। করোনা উপসর্গ থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী প্রতারকচক্রের কয়েকজন সদস্যকে প্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও। তখন অন্তত: ৩৭ জনকে ভুয়া ফল দেয়ার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিতও হয় পুলিশ। অধিকতর তদন্তের জন্য পাঁচটি ল্যাবটপ, দু’টি ডেস্কটপ এবং করোনা সংগ্রহের তিন হাজার কিট জব্দ করা হয়।

 বলা বাহুল্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে পুরো বিশ্বই অসহায় হয়ে পড়েছে। এখ নপর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নমুনা পরীক্ষা নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে। এমন অবস্থায় যদি এই ধরণের কুচক্রীরা করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করে, পরীক্ষা ছাড়াই  ভুয়া সনদ দেয়, তবে তা কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে তা অনুধাবন করে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। প্রসঙ্গত বলা দরকার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান শেষে র‌্যাবের নির্বাহী হাকিম সারোয়ার আলম বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল যে পরিমান পরীক্ষা করেছে, তার প্রায় তিন গুন বেশি নমুনা সংগ্রহ করলেও পরীক্ষা না করেই ইচ্ছেমত প্রতিবেদন দিয়েছে।

 এভাবে তারা এক কোটি সাতচল্লিশ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সঙ্গত কারণেই এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে যেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তেমনিভাবে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর হতে হবে।সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, করোনার সুযোগ নিয়ে যারা বাণিজ্যে মেতে ওঠেছে তাদের ক্ষেত্রে কোন অনুকম্প প্রদর্শন নয়;বরং আইন মোতাবেক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ য়েখানে অসহায় হয়ে পড়েছে, সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে যারা স্বার্থ আদায়ে মরিয়া তাদের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে এই ধরণের অপরাধমূলক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সব সব ধরণের পদক্ষেপ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রিজেন্ট হাসপাতালের ঘটনার সাথে যত বড় মাপের লোকজন জড়িত থাকুক না কেন; তাদেরকে পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনতে পারলে সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে।

এছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু জায়গা একই ধরণের অনিয়মের রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে ঈশ্বরদীর রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিকের মালিক আব্দুল ওহাব রানাকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার (৮ জুলাই) রাতে তাকে আটক করা হয় মর্মে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে,এই ঘৃণ্য কাজের সাথে জড়িত আরশেদ আলী ও সুজন আহম্মেদ এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

 তারা দেশের একমাত্র মেগা প্রকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টার্গেট করে নমুনা পরীক্ষার নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫/৬ হাজার টাকা করে নেন। এভাবে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই ক্লিনিক মালিক। সংগ্রহকৃত নমুনা পরীক্ষার জন্য সেগুলো ব্রাাহ্মণবাড়িয়া  মেডিকেল কলেজে পাঠানো হতো।ওই মেডিকেলের ডাঃ আবু সাঈদের স্বাক্ষরে ফলাফল ক্লিনিকের ঠিকানায় পাঠানো হয়। সব ফলাফল নেগেটিভ দেখিয়ে পাঠানো হয়। যাতে বিদ্যুৎ পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করতে ফলাফল প্রাপ্তিদের কোন বাধা না হয়।

 অথচ সেখানে দিন দিন করোনা রোগীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকে। ওই ক্লিনিকের নমুনা সংগ্রহ করার স্বাস্থ্য বিভাগের কোন অনুমতি ছিল না। যারা অর্থের মহে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে ভয় পায় না; তারা সমাজের বিষ ছাড়া কিছুই না। তাই মানষের জীবন-মরণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মত্ত পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; যাতে আর কেও এধরণের ঘৃণ্য অপরাধ করতে সাহস না পায়। এটাই দেশবাসীর কামনা। 

এম মাহফুজ আলম : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক ।