বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নারীরা। ফাইল ছবি।
অধ্যাপক ডা. শামছুন নাহার
আদ্-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
মুক্তিযুদ্ধে বাংলার প্রতিটি মা-বোন একেকজন একেকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন । কেউ নির্যাতিত হয়ে, কেউবা ধর্ষণের শিকার হয়ে, আবার কেউ তাদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ অথবা সাহায্য করে, আবার কেউ স্বামী, পুত্র, বাবা হারিয়ে। ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমি দেছো পা, আমি দিছি জরায়ু "মাখনকে বেণু বলছে" প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের "যুদ্ধ উপন্যাসে" এইভাবে নান্দনিক চিত্র ফুটে ওঠেছে। একজন বীরঙ্গনা নারী হিসেবে যুদ্ধে নারী-পুরুষের সমান অংশিদারিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিসেনা নিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো। বর্ষাকাল, রাত তিনটে দরজায় মৃদু খুটখাট শব্দ। আমরাতো ভয় পেয়ে গেলাম। এত রাতে কে? মা উঠে দরজা খুলে দিলেন। পাশের গ্রাম রাঙ্গালিয়ার এক ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ। সাথে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা রোজ। তাদের আবদার রোজকে বাড়িতে রাখতে হবে। আবদুল্লাহ মুক্তিসেনা মাঝে মাঝে থাকে। ভাঙ্গুড়া বাজার মিলিটারি ক্যাম্প আমাদের বাড়ি থেকে দুই মাইল। জানতে পারলে গুষ্টিসুদ্ধ বন্দুকের আগায় জীবন দিতে হবে। মা মৃদু আপত্তি জানিয়েছিল। তাদের এক কথা অন্য বাড়ি থাকতে সাহস পাইনা। আপনাদেরই রাখতে হবে। অবশেষে রোজ ছিল একটা পরিত্যাক্ত ঘরের এককোনে। বাড়ির কারো সাথে দেখা হতো না তার। খাবার তার ঘরে দিয়ে আসা হতো। মাঝে মধ্যে আমার ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে চটের ব্যাগে অস্ত্র নিয়ে আশেপাশের গ্রামে যেতো। রনজু নৌকা চালাতো। এভাবে মাস তিনেক ছিল।
একদিন দুপুরে এক নৌকা ভর্তি মুক্তিসেনা আমাদের ঘাটে এসে থামলো। আমরা তখনো খানিকটা ভয়ে সিটকে গিয়েছিলাম। তারা সরাসরিই আমাদের বাড়িতেই এলো। বললো আমাদের কয়দিন খাওয়া-গোসল নাই। আমরা দুপুরে এখানে খাবো, ভাত রান্না করেন। আর সাবান দেন গোসল করবো। তারা মোটামুটি ১০/১২ জন। মা তাড়াতাড়ি ভাত বাসালেন ও বড় একটি মোরগ জবাই করলেন। ডাল রান্না হলো আর বাসার তরকারি ছিল। তাই দিয়ে তারা খেতে বসলো। নিচে পাটি পেড়ে দুই সারি করে বসল। খাওয়ার সময় আমাকে বললো আমাদের কি তুমি চেনো? আমি বললাম না চিনিনা। তখন বললো তোমাদের বাশুরিয়া দাদার গ্রামের পাশে পূরান্দপূর আমার বাড়ি। আমি বললাম আপনারা তাহলে আমাদের চিনেই এসেছেন? আমাদের পাশের গ্রাম পাটুলীপাড়া। সে গ্রামের তিনজন মুক্তিসেনার মধ্যে মোজাম্মেল ও শাহজাহান আমার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট। তারা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো। তখন যে এটা এত রিস্কি ছিল অতটা ভেবে দেখিনি। তবে এখন মনে হলে শরীর হিম হয়ে আসে ভয়ে। এভাবে বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তি সেনাদের যে যেমনভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে।
জাহানারা ইমাম, এক অনবদ্য নাম। যার প্রচ্ছন্ন সায় পেয়ে বড় ছেলে রুমি বিদেশে ভর্তি হবার সব আয়োজন উপেক্ষা করে যুদ্ধে গিয়েছিল। কয়েকটি গেরিলা আক্রমন সফলভাবে করার পর মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েছিল। তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন। জাহানারা ইমামের ৭১ এর দিনগুলোতে দেখতে পাই কিভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নিজের ছেলে স্বামীকে হারিয়েছিল। স্বামী ছেলের মৃত্যু শোক কাটাতে পারেননি। যুদ্ধের সময়ই হার্ট ফেল করে মারা যান। তিনি শহীদ জননী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তার এ অবদান স্মরনীয় হয়ে আছে ও থাকবে।
১৯৭১ সালে নারীরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। এই অসামান্য অবদান অনেককাল রাষ্ট্র, সমাজ, জনগন কেউ তেমন গুরুত্বের সাথে দেখেনি। কোনো মতে দায়সারা গোছের বীরঙ্গনা উপাধি দিয়েই নিজেদের ধন্য মনে করেছিল। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মত সরকার নারী উন্নয়ন নীতিতে নারীদের মুক্তিযুদ্ধের অবদান স্বীকৃতি দেন। যুদ্ধের সময় পরিবার, সমাজ, বাঙ্কারে, যুদ্ধ ময়দানে, শরনার্থী শিবিরে নারীর সরব উপস্থিতি এই স্বীকৃতি পেতে সাহায্যে করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী দুই নারীকে বীরপ্রতিক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একজন তারামন বিবি, আরেকজন সেতারা বেগম। তারামন বিবি দেশের মধ্যেই গাইবান্ধা অঞ্চলে দুই-তিনটা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর সেতারা ইন্ডিয়াতে শরনার্থী শিবিরে আর্মি মেডিকেল কোরে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছিলেন। তাদের ১৯৯৫ সনে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৯৯৫ সালে সন্ধান পাওয়া যায় আরো এক নারীকে তার নাম কাকন বিবি। সিলেটের সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজারে লক্ষ্মীপুর গামের এই খাসিয়া নারী অন্তত ২০টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি খাসিয়া বেটি নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বেগম সুফিয়া কামাল গড়ে তুলেছিলেন "পুর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ।" তার কার্যক্রম শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সারাদেশে ছড়ানো ছিল। তখনকার কিছু নারীদের আমরা স্মরণ করতে পারি। যেমন পাবনায় নেতৃত্ব দেন রাকিবা খাতুন, ঈশ্বরদীতে মিসেস জসিম মণ্ডল, বরিশালে মনোরোমা বসু, কুমিল্লায় সেলিনা বানু। আরো অনেক নাম না জানা মা-বোনেরা।