মেসি-রোনালদোর মিল আছে যে সকল দিক দিয়ে

মেসি-রোনালদোর মিল আছে যে সকল দিক দিয়ে

মেসি-রোনালদো

ফিফার নানা পুরষ্কার দুজনেই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এক দশকের বেশি সময় ধরে।এখন পর্যন্ত আমি যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি সবচেয়ে বেশি সেটা হলো- "মেসি নাকি রোনালদো, কে সর্বকালের সেরা?"

এর উত্তর দেয়া সহজ এবং একই সাথে অসম্ভবও, তারা দুজনই সেরা।

প্রজন্মের সবচেয়ে বড় দুই তারকা ফুটবল মাঠে মুখোমুখি হচ্ছে প্রায় আড়াই বছর পর।

মেসি সেরা খেলোয়াড় এবং রোনালদো সেরা স্ট্রাইকার, বিষয়টা আমি এভাবেই ভাবি।

যেভাবেই ভাবেন না কেন এইক্ষেত্রে খুব একটা প্রাসঙ্গিক ও ত্রুটিমুক্ত কোনো উপসংহার টানা সম্ভব নয়। আবার মানুষ এই দুজনের তুলনা করার সময় একটা ভুলও করে থাকে, যেটা হলো, এই দুজনকে প্রশংসা করতে গিয়ে দুজনের পার্থক্যগুলোকেই সামনে আনা হয় বেশি।

দুজনের বাহ্যিক রূপের কারণে একটি বিষয় আড়ালেই থাকে। সেটা হচ্ছে দুজনের মধ্যে অনেক কিছুতে মিলও আছে।

একইরকম অতীত

রোনালদো এবং মেসি, দুজনই উঠে এসেছেন বেশ সাদামাটা পরিবার থেকে।

বাবা-মা'র চার সন্তানের মধ্যে রোনালদো সবার ছোট।

রোনালদোর বাবা ছিলেন ঋণে জর্জরিত একজন মালি। মা ছিলেন রাঁধুনী।

হোর্হে মেসির চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় লিওনেল মেসি। তিনি ছিলেন একজন স্টিল ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। মেসির মা সেলিয়া চুচিত্তিনি চুম্বক তৈরির কারখানায় কাজ করতেন।

যখন তারা দুজন হাঁটতে শেখেন, তখন থেকেই তারা ফুটবল খেলা শুরু করেন। গ্রেট ফুটবলার হতে তাদের যে তাড়না ছিল তার জন্য এই দুজনই সবকিছু বাজিতে রাখতে পারতেন। এমন না যে তারা খুব সাহসী বা খুব জেদি ছিলেন খেলার বিষয়ে, কিন্তু তাদের কোনো দ্বিতীয় অপশন ছিল না। তাদের মনে অন্য কোনো অপশন ছিল না। কোনো সন্দেহ ছিল না। সন্দেহ স্বপ্নভঙ্গ করে।

রোনালদোর বাড়ি পর্তুগালের মাদেইরায়, ১২ বছর বয়সে এই শহর ছাড়েন তিনি। গলায় নাম ঝুলিয়ে লিসবন যান তিনি। সেখানে সতীর্থদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকারও হন রোনালদো, মাদেইরার আঞ্চলিক উচ্চারণের কারণে।

মেসিও ঘর ছাড়েন ১২ বছর বয়সে। আর্জেন্টিনা ছেড়ে তিনি যান স্পেনে। তবে মেসির সাথে তাঁর পরিবারও ছিল সেই সময়।

প্রথম ম্যাচ থেকেই শ্রেষ্ঠত্বের পথে

২০০২ সালের ৭ই অক্টোবর, ১৭ বছর বয়সে, রোনালদো প্রথম স্পোর্টিংয়ের হয়ে মাঠে নামেন।

মেসি বার্সেলোনার মূল দলের হয়ে মাঠে নামেন যেদিন তাঁর বয়স ১৬ বছর চার মাস ২৩ দিন। জোসে মরিনিয়োর পোর্তোর বিপক্ষে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন মেসি।

তখন থেকেই এটুকু সবার মনে গেঁথে যায়, এই দুজন বিশ্ব ফুটবলের বড় ফুটবলার হবেন।

২০০৩ সালে ইংলিশ কিংবদন্তী ফুটবলার জর্জ বেস্ট রোনালদোকে নিয়ে বলেন, "অনেক ফুটবলারকেই 'নতুন জর্জ বেস্ট' ট্যাগ দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এবার আমার জন্য এটা একটা সম্মানের ব্যাপার।"

বার্সেলোনার সহকারী কোচ হেঙ্ক টেন কেইট মেসির খেলা দেখে বলেন, "মনে হচ্ছিল মেসি যেন জীবনভর আমাদের সাথে খেলেছে।"

মেসিকে প্রথমবার অনুশীলনে দেখেই ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদিনহো বলেন, "খুব জলদি মেসি বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবেন।"

দুজনই নিজ দলে বড় অবদান রাখেন

হারের মুখ থেকে জয় এনে দেয়ার ক্ষমতা আছে লিওনেল মেসির। যে কারণে আন্তর্জাতিক ফুটবল ভাষায় যোগ হয় নতুন শব্দ- 'মেসিডিপেন্ডেনশিয়া'।

শেষ ১১ মৌসুমে ৭ বার স্পেনের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার 'পিচিচি ট্রফি' পান লিওনেল মেসি। বাকি চারবারের তিনবার এই পুরষ্কার পান রোনালদো।

২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে রোনালদো বিশেষ অবদান রাখেন রেয়াল মাদ্রিদকে জেতাতে।

যদিও রেয়াল মাদ্রিদের গত এক দশকের সাফল্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন রোনালদো, তবুও বার্সেলোনায় মেসি যে সম্মান পান সেটা তিনি রেয়াল মাদ্রিদে পান না বলে ধারণা করেন রোনালদো।

রেয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে তিনি বলেন, "টাকার প্রশ্ন যদি আসে আমি ১০০ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে আসবো।"

পেরেজ পাল্টা বলেন, "যদি আপনি যেতে চান, মেসিকে সই করানোর মতো অর্থ দিয়ে যান।"

রোনালদো রেয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ১৬ পার করতে পারেনি ক্লাবটি।

হারতে ঘৃণা করেন দুজনই

হারের অভিব্যক্তি দুজনের দু রকম, যেমনটা তাদের ডিএনএতে প্রতিফলিত হয়।

রোনালদো উঁচু গলায়, ঝাঁঝালো ভাষায়, যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিমায় এবং মুখোমুখি অনুভূতি প্রকাশ করেন।

মেসি খানিকটা অন্তর্মুখী, কথা বার্তাও বলেন না কখনো কখনো, কখনোবা এর রেশ বেশ কয়েকদিন থাকে।

যদিও এই দিক থেকে তাদের বাহ্যিক রূপে বিশাল পার্থক্য আছে, কিন্তু যেই ভাবাবেগ তাদের ছুঁয়ে যায়, তার তীব্রতা দুজনেরই একরকম।

তারা যদি নিজেদের জয়ী হওয়ার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকায় না দেখতেন, তবে হয়তো এভাবে তৈরি হতেন না দুজন, শৈশব থেকে।

দল হারুক জিতুক কিংবা ড্র করুক, লিওনেল মেসি তার ফুটবল জীবনের শুরুর দিকে কাঁদতেন রীতিমতো নিজে গোল করতে না পারলে।

রোনালদোর ক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছিলো না, চেলসির সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে পেনাল্টি মিস করার পর যে কাঁদছিলেন সেটা পরবর্তীতে খুশির অশ্রুতে পরিণত হয় কি না। কারণ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে একমাত্র তিনিই পেনাল্টি মিস করেন।

দুজনেই নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেছেন

বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেছেন দুজনই। হাঁটুতে সমস্যা হওয়ার পর রোনালদো মেনে নেন যে তিনি আর আগের মতো করে গতির ঝড় তুলে ডিফেন্সে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারবেন না। তিনি নিজেকে দ্রুতগতির উইঙ্গার থেকে ফুটবলের সেরা স্ট্রাইকারে পরিণত করেন।

মেসিও শুরুতে উইঙ্গার ছিলেন, ফরোয়ার্ড হওয়ার পর তিনি বিশ্বের সেরা নম্বর টেনে পরিণত হন- যদিও আমার মতে এখানে পেলে ও দিয়েগো ম্যারাডোনাও থাকবেন।

শুধু গোল দিয়েই মেসি সন্তুষ্ট থাকেন না, মিডফিল্ডেও মেসির ভূমিকা থাকে। গোল করানোর দিক থেকেও মেসি লা লিগার সেরাদের একজন।

একে অন্যের পরিপূরক

মেসি ও রোনালদো যদি এমন প্রতিপক্ষে পরিণত না হতেন তবেও কি তারা এমন সফল থাকতেন?- আমার মনে না।

ফর্মুলা ওয়ান রেসিং বা গ্রাঁ প্রি তারকা নিকি লাউদা একদা বলেছিলেন, "একজন শত্রু থাকা আশীর্বাদ।"

২০১৩ সালের ২৭শে জানুয়ারি মেসি ওসাসুনার সাথে চার গোল দেন, ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা পরে রোনালদোও হ্যাটট্রিক করেন গেতাফের সাথে। কাকতালীয় মনে হচ্ছে? আমার মনে হয় না।

একবার লেখক ও শারীরিক কোচ পেদ্রো গোমেজ আমাকে বলেন, নিজের প্রতি যে প্রত্যাশা সেটা বাড়তে থাকে যখন শত্রু আরো ভালো করে।

"আমরা যখন ছোট ভাবি, তখন ছোটই থাকি। আমরা যদি প্রতিদিন নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রেরণা না খুঁজে পাই, তবে আমরা থেকে যাবো। একজন যদি না থাকতেন, আরেকজন হয়তো ২৫ গোলেই সন্তুষ্ট থাকতো।"

আগে স্পেনে, এখন ইউরোপিয়ান মঞ্চে মেসি ও রোনালদো, একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় ব্যস্ত থাকেন। 

সূত্র: বিবিসি