সম্মানিত মাস মহররম : করণীয় ও বর্জনীয়

সম্মানিত মাস মহররম : করণীয় ও বর্জনীয়

সম্মানিত মাস মহররম : করণীয় ও বর্জনীয়

শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে সম্মানিত মহররম মাস হিজরি সনের প্রথম মাস। কুরআনে বর্ণিত চারটি মর্যাদার মাসের মধ্যে একটি অন্যতম মাস। এ চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সবরকম পাপাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনে :
‘নিশ্চয়ই মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে ১২ মাস আল্লাহর কিতাবে, সে দিন (থেকে) যে দিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের ওপর জুলুম করো না’ (সূরা আত-তাওবাহ-৩৬)।

রাসূল সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘সময় ও কাল আবর্তিত হয় নিজ চক্রে। যে দিন থেকে আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এক বছর হয় বারো মাসে। এর মধ্যে চার মাস সম্মানিত। তিন মাস ক্রমান্বয়ে আসে। যেমন : জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং রজব (বুখারি : ৪৪০৬)। আশুরা তথা ১০ মহররমের মর্যাদা ও তাৎপর্য কুরআন ও হাদিস দ্বারাও স্বীকৃত।

আশুরার প্রেক্ষাপট : বর্তমান মুসলিম সমাজে শিয়া সম্প্রদায়ের শিরকি ও বিদয়াতি কর্মকাণ্ডের কারণে মহররম ও আশুরা বলতে অনেকেই কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাসকেই বুঝে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মহররম ও আশুরার মর্যাদা, ফজিলত ও আমলসমূহ কারবালার ঘটনারও অনেক আগেই সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও হাদিসে এসেছে। এ দিনে রাসূলুল্লাহ সা: বিশেষ গুরুত্বের সাথে রোজা রাখতেন। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত ‘রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় (হিজরত করে) এলেন এবং ইহুদিদের আশুরার দিন সিয়াম পালন করতে দেখলেন। এরপর তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এ সে দিন যে দিন আল্লাহ মূসা আ: ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের ওপর বিজয়ী করেছেন।

তাঁর সম্মানার্থে আমরা সাওম পালন করি। তখন নবী সা: বললেন, আমরা তোমাদের চেয়েও মূসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে সাওম পালন করার নির্দেশ দেন’ (মুসলিম-২৫৪৬)।রমজানের একমাস রোজা হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। যখন রমজানের রোজাকে ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজার বিধান আর ফরজ থাকেনি, নফল হয়ে যায়। কারবালার ঘটনার আগেই মহররম মাস অতীতে ঘটা দুটি অলৌকিক ঘটনার জন্য সম্মানিত। সহিহ হাদিস মতে, মহররম মাসে

১. আল্লাহ তায়ালা মূসা আ: ও তাঁর সঙ্গীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে রক্ষা করেন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা নীল নদের পানির মধ্যে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।একই রাস্তা পার হওয়ার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদল ডুবে মারা যায়। আর তারপর ফেরাউনের লাশ হাজার বছর ধরে পানির নিচে অক্ষত অবস্থায় থাকে, যা বিশ্বাসীদের জন্য অনেক বড় নিদর্শন।

২. রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওফাতের পর ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন রা:-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। তাঁকে ইয়াজিদের বাহিনী নির্মমভাবে শহীদ করে। এই ঘটনা অবশ্যই প্রতিটি মুসলিম হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। কিন্তু আমরা সেই শোক ও কষ্টকে প্রকাশ করার জন্য এমন কোনো কাজ করব না যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। ইসলামী শরিয়তে কোনো দিবসের মর্যাদা, তাৎপর্য ও ফজিলত রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওফাতের আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। আর সে অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই। তাই কোনো মুসিবত বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো দিন বা মাসে নতুন কোনো বিধান আবিষ্কার করা অনুচিত, যা সুস্পষ্ট বিদয়াত।

করণীয় : সম্মানিত এ মাসে রাসূলুল্লাহ সা: বেশি বেশি নফল রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন, ‘রমজান মাসের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোজাই সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ’ (তিরমিজি-৭৪০)।নফল রোজার মধ্যে নবী সা: আশুরার দিনের রোজাকে অন্য সব দিনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত ‘আমি আল্লাহর রাসূল সা:কে আশুরার দিনের সাওমের ওপর অন্য কোনো দিনের সাওমকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি’ (বুখারি-২০০৬)।

ইহুদিরাও শুধু আশুরার দিনে রোজা রাখত, তাই নবী সা: তাদের সাথে সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মহররমের ১০ তারিখের আগে বা পরে মোট দুটি রোজা রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন, ‘তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে, আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো’ (মুসনাদে আহমাদ-১/২৪১)।এ মাসে বেশি বেশি তাওবাহ ও ইস্তিগফার পড়তে বলা হয়েছে। কেননা অতীতে একটি গোত্রের তাওবা এ মাসে কবুল হয়েছিল। এ ছাড়া দরূদ পড়া, কেননা ইস্তিগফার ও দোয়া কবুলের জন্য অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে দরূদ পড়া। এটি যেহেতু সম্মানিত মাস, তাই এ মাসের সম্মানে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকার চেষ্টা করা।

বর্জনীয় : আশুরায় শিয়া সম্প্রদায়ের মতো শোক প্রকাশের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কোনো বিপদ-আপদের শোককে জিইয়ে রেখে দিনের পর দিন স্মরণ করা ইসলামের রীতিবহির্ভূত। আবদুুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গণ্ডে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে এবং জাহেলি যুগের মতো চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’ (বুখারি-১২৯৪)।

ইসলামি শরিয়াহ মতে, ‘চোখ আর অন্তর থেকে যা কিছু আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তা রহমতের অংশ। কিন্তু যা কিছু হাত ও জিহ্বা থেকে আসে, তা আসে শয়তানের পক্ষ থেকে’ (মুসনাদে আহমাদ-১/১৩৮:২১২৭)।
আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে আশুরার দিন শিয়ারা তাজিয়া মিছিল বের করে। এ ধরনের মিছিল ও এ সংশ্লিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান (শোক র্যালি, প্রতীকী কবর, ঘোড়ার মূর্তি ইত্যাদি) সম্পূর্ণভাবে অনৈসলামিক এবং বিদয়াত।

আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত সম্মানিত মহররম মাসে আশুরার দিনগুলো ছাড়াও আমরা বেশি বেশি রোজা রাখব এবং তাওবা করব। এটিই প্রকৃত মুসলিম ও সুন্নাহর অনুসারীদের মহররম-আশুরা উদযাপন। আমরা কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়া রাসূলুল্লাহ সা:-এর বংশধরদের জন্য দোয়া করব। এর পাশাপাশি মহররম ও আশুরা-বিষয়ক সব ধরনের কুসংস্কার, কুপ্রথা থেকে নিজেদের বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করব। এ দিবসকেন্দ্রিক শিয়া সম্প্রদায় আয়োজিত আচার-অনুষ্ঠানকে মন থেকে বর্জন করব এবং এসব কর্মকাণ্ডের দর্শক হওয়া থেকেও নিজেদের বিরত রাখব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন, আমীন।