লজ্জা ঈমানদারদের নিরাপত্তা দেয়াল

লজ্জা ঈমানদারদের নিরাপত্তা দেয়াল

লজ্জা ঈমানদারদের নিরাপত্তা দেয়াল

আমাদের সমাজে একটি কথা বহুল প্রচলিত ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’। আসলে শুধু কি তাই? লজ্জা নারীকে সুন্দর করে তোলে। তার সম্মান মর্যাদা, আভিজাত্য প্রকাশ পায়। লজ্জাহীন নারী থেকে ভ্রষ্টরা নষ্ট স্বার্থ হাসিল করার জন্য বাহবা দিলেও অন্তর থেকে পছন্দ করে না। আপন করে নিতে পারে না। স্বার্থ হাসিলের পর কলার ছোলার মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিতে সামান্যও দ্বিধা করে না। এই লজ্জা শুধু নারীর ভূষণ নয়, সব ঈমানদারের জীবনের, ঈমানের ভূষণ। একজন মানুষ যখন নির্লজ্জ হয়ে যায়, সে তখন ঈমান রক্ষার প্রাচীরটিকে চুরমার করে দেয়। তার ঈমান আর তখন নিরাপদ থাকে না। তার ঈমান রক্ষা করা কঠিন থেকে কঠিনতর রূপ নেয়। সে পাপ থেকে বাঁচতে পারে না। এমনকি পাপ থেকে বাঁচার চিন্তাও তার মাথায় আসে না। আসতে পারে না।

লজ্জাহীন মানুষ পাপকে পাপ মনে করে না। তার বিবেকের চোখ ঢেকে যায়, বিবেক মরে যায়। সে ভালো-মন্দ সব কিছুকে একই রকম দেখে। তাই রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানের ষাটের উপরে শাখা রয়েছে। আর লজ্জা ঈমানের বিশেষ একটি শাখা।’ অন্য হাদিসে জুহায়র ইবনে হারব রহ: আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানের শাখা ৭০টিরও কিছু বেশি। অথবা ৬০টিরও কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত ইলাহ নেই এ কথা স্বীকার করা, আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। আর লজ্জা ঈমানের বিশিষ্ট একটি শাখা।

ঈমান রক্ষায় লজ্জার ভূমিকা অপরিসীম। তাই ওই হাদিসে ঈমানের প্রথম শাখা আল্লাহর ওপর ঈমান আর শেষ শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর বিশেষভাবে লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: পর্দার আড়ালে থাকা কুমারী নারীর চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি কোনো বিষয় অপছন্দ করলে আমরা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারতাম।

লজ্জাশীলতা কাকে বলে, ওলামায়ে কেরাম তার সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন, উলামাগণ বলেন, ‘লজ্জাশীলতার প্রকৃত অর্থ হলো এমন সৎচরিত্রতা, যা নোংরা বর্জন করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং অধিকারীর অধিকার আদায়ে ত্রুটি প্রদর্শন করতে বিরত রাখে। আবুল কাসেম জুনাইদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘লজ্জাশীলতা হলো নিয়ামত লক্ষ্য করা এবং সেই সাথে (তাঁর কৃতজ্ঞতায়) ত্রুটি লক্ষ করা। এই দুয়ের মাঝে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তাকেই লজ্জা বলা হয়।’ নিন্দা সমালোচনার ভয়ে কোনো দোষণীয় কাজ করতে মানুষের মধ্যে যে জড়ত্ববোধ বা অপরাধবোধ জাগ্রত হয়ে থাকে তাকে হায়া বা লজ্জা বলে। এই লজ্জা মানুষকে ভালো কাজের পদক্ষপে গ্রহণ করতে এবং মন্দ বা পাপকাজ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।

লজ্জা ঈমানদারদের ঈমান রক্ষার পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা প্রাচীর। বাসার দেয়াল ভেঙে গেলে, নড়বড়ে হয়ে গেলে যেমন নিজের মাল, সম্পদ এমন কি নিজের জীবন পর্যন্ত চোর ডাকাত শত্রুর হাত থেকে বাঁচানো যায় না, তেমনি কোনো মানুষের লজ্জা উঠে গেলে তার মধ্যে কোনো পাপ বোধ, অপরাধ বোধ, অনুশোচনা কোনো কিছুই থাকে না।

তার দ্বারা হবে না এমন কোনো কাজ বাকি থাকে না। মানুষ যখন নির্লজ্জ হয়ে যায় তখন সে একাই পাপ করে না। অন্যকেও পাপ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইবনে কুতায়বাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নিশ্চয় লজ্জা তার অধিকারী ব্যক্তিকে অর্থাৎ লজ্জাশীল ব্যক্তিকে অবাধ্য বা পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে যেমন ঈমান বিরত রাখে। এ জন্যই হাদিসে লজ্জাকে ঈমান বলা হয়েছে। যেভাবে কোনো জিনিস অন্য জিনিসের স্থলাভিষিক্ত হলে তাকে সে জিনিসের নামেই নামকরণ করা হয়।

আজকাল আমরা লজ্জা কাকে বলে এই জিনিসটিই ভুলে গেছি। এতে করে সমাজে অনাচার, দুরাচার, বেহায়পনা, অশ্লীলতা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি অপরাধে সমাজ ছেয়ে যাচ্ছে। কারণ আমাদের কাছে লজ্জার পরিচয় নেই। লজ্জার রক্ষা নেই। লজ্জার লালন নেই। নির্লজ্জ আর বেহায়াপনায় সব ছেয়ে গেছে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত একদিন রাসূল সা: এক আনসারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর ভাইকে তখন (অধিক) লজ্জা ত্যাগের জন্য নসিহত করছিলেন। রাসূল সা: তাকে বললেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও। কারণ লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’ (বুখারি)।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ; ঈমানের স্থান হলো জান্নাতে। অশ্লীলতা হলো অবাধ্যতা ও অন্যায়াচারের অঙ্গ, অন্যায়াচারের স্থান হলো জাহান্নাম’ (তিরমিজি)। আল্লামা রাগিব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, লজ্জা আত্মাকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। মানুষের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার মনে যা চায় সেসব কাজ করে পশুর মতো হবে না। যে পাপ থেকে নিজেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে, আর এ কারণেই লজ্জাশীল ব্যক্তি ফাসিক হয় না। এ কারণেই রাসূল সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয় লজ্জা করা ঈমানের অঙ্গ’।

লজ্জা মানুষকে নিষিদ্ধ ও পাপের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। ঈমান যেমন মহান আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করার নাম, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহকে না দেখে তাকে লজ্জা করে হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হায়া বা লজ্জা। যে ঈমানদার লজ্জাশীল সে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভালোবাসে, ভয় করে এবং লজ্জা পায়। কেননা, হাদিসে আছে আল্লাহর কাছে লজ্জাশীল হওয়াই বেশি হকদার। লজ্জাশীল ঈমানদার প্রকাশ্যে যেমন পাপ থেকে বেঁচে থাকে তেমনি গোপনেও পাপ থেকে বেঁচে থাকে। মূলত লজ্জাই ঈমানের বহিঃপ্রকাশ।

কাজেই যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে আল্লাহকে লজ্জা করে বিরত থাকাই হলো ঈমানের দাবি। লজ্জা ঈমানের ভূষণ নয় অস্তিত্ব। কোনো নির্লজ্জ ব্যক্তি ঈমানদার দাবি করার সুযোগ কোথায়? ভূষণ হলে টানাটানিতে ছিঁড়ে যেত, খশে পড়ে যেত। যেহেতু ঈমানদার ব্যক্তি সবসময় লজ্জাশীল। কোনো অবস্থায়ই লজ্জাবিমুখ হতে পারে না। তাই ঈমানদারের লজ্জা তার অস্তিত্বে মিশে আছে।

যখন কেউ লজ্জা হারিয়ে ফেলে তখন তার সাথে মানুষ আর পশুর পার্থক্য থাকে না। তার বিবেক মরে যায়। তার মন নিচ থেকে আরো নিচে চলে যায়। কোনো মানুষ তাকে লজ্জা শেখাতে পারে না। সে কাউকে পাত্তাই দিতে চায় না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘পূর্ব যুগের আম্বিয়ায়ে কেরামগণের যেসব উক্তি মানব জাতি লাভ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো ‘যখন তোমার লজ্জা না থাকে, তখন তোমার যা ইচ্ছা তা ই করতে পারো।’

লজ্জা শুধু নারীরই নয়, সব ঈমানদারের লজ্জা লালন করা খুবই জরুরি, যদি ঈমানকে হিফাজত করতে চায়। হ্যাঁ, অন্যান্য অনেক কারণে নারীদের লজ্জাশীল হওয়া আরো বেশি প্রয়োজন। এক চিন্তাশীল বলেছেন, যখন কোনো মেয়ের লজ্জায় রক্তগণ্ড হওয়া বন্ধ হয়ে যায় তখন থেকে তার সৌন্দর্যের সবচেয়ে শক্তিশালী মোহরকেও হারিয়ে ফেলে।