মেস জীবন এখন আরও দুর্বিষহ

মেস জীবন এখন আরও দুর্বিষহ

ফাইল ছবি

ফাহিমা আক্তার সুমি: হতাশা ও বিড়ম্বনায় দিন কাটে নাহিদুর রহমান সুমনের। উচ্চ শিক্ষার জন্য খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছেন। বাবা-মা ও নিজের স্বপ্ন পূরণে ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্যামলীতে ভাড়া নেন বাসা। প্রথমদিকে ভালোভাবে সবকিছু চললেও এক সময় দেখা দেয় টানাপড়েন। মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় বাবাকে অর্থ ব্যয়ে হিমশিম খেতে হয়। নাহিদের বাবা অল্প বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এই স্বল্প বেতনে বহন করতে হয় সংসারের সব খরচ।

বছরখানেক পরে নাহিদের পড়াশোনার খরচ ও বাসাভাড়া পরিশোধে বিঘ্ন ঘটতে শুরু করে। শুরুতে একা থাকলেও পরে বাসায় আরও কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করেন মেস জীবন। দিনে দিনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় মেস জীবনও এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে সুমনের কাছে। শুধু সুমন নন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে শিক্ষা বা চাকরির জন্য মেসে বসবাস করেন এমন মানুষদের দিনযাপন এখন কষ্টকর হয়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দামের কারণে।

সুমন বলেন, আমার কোনো আয় নেই, শুধু আছে ব্যয়। বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। কখনো কখনো না খেয়ে থাকতে হয়। এক কেজি তেল ১৬০ টাকা দরে ক্রয় করেছি। তেল কিনলে চাল কেনার টাকা থাকে না। মাঝে মাঝে বাসায় কোনো বাজার থাকে না। কলা-রুটি খেতেও হয়। মাছ, মাংস তো দূরের কথা। এদিকে পড়াশোনা বন্ধ রেখে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আমি ক্লান্ত।

রাজাবাজারের একটি মেসে থাকেন মিম রহমান। সঙ্গে তার ছোট বোন শিউলিও থাকেন। বাবা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মিম বলেন, ২০১৯ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। প্রথমদিকে বাবার খরচ পাঠাতে কোনো সমস্যা হয়নি। ২০২০ সালে ছোট বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোচিংয়ের জন্য আসে। দুই বোন একটা মেসে থাকা শুরু করি। দুই বোনের খরচ দিতে বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমার কোনো ভাই না থাকায় বাবা আমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি করানোর আশা করেন। বাবার কষ্ট দেখে আমি দুইটা টিউশনি করা শুরু করি। এরমধ্যে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। মেসে সিট রেখে চলে যেতে হয় গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। লকডাউন শেষে আবার ফিরে আসি। কিন্তু টিউশনি আর পাই না। খুঁজতে থাকি সুপার শপ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি। কোথাও পাই না। এদিকে বাবার একার পক্ষেও আমাদের দুই বোনের খরচ চালানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। অন্যদিকে মায়ের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়ায় প্রতিমাসে তার পেছনে চিকিৎসা খরচ অনেক। কোথাও চাকরি না হওয়ায় শেষমেশ একটি টিউশনি শুরু করি। তাতে আমাদের কোনো লাভ হয় না। আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি হয়। ভালোমন্দ খাবার আর খেতে পারি না। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ায় ভর্তা আর ডিম খেতে হয় বেশি। শুধু মেস ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ও যাতায়াতে সব টাকা চলে যায়।

সীমা আক্তার বলেন, অনার্সের তৃতীয় বর্ষ চলে। ময়মনসিংহ থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকাতে পড়তে এসেছিলাম। প্রথমে একটি হোস্টেলে উঠি। সেখানে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। খাবার ও খুব একটা ভালো লাগতো না। এরপর কয়েকজন বান্ধবী মিলে একটা মেস নেই। সেখানে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু কিছুদিন পরে শুরু হয়ে টানাপড়েন। পড়াশোনার খরচ চালাতে চালাতে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয় না। টাকা হাতে না থাকলে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নেই। কিন্তু পরবর্তীতে পরিশোধ করতে গেলেও কষ্ট হয়। একটা টিউশনি শুরু করি। বাজারে গেলে দাম শুনে ফিরে আসি। সবকিছুর দাম সাধ্যের বাইরে। তিনটা টমেটো ৪০ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি। ব্রয়লার মুরগির দাম শুনে না কিনে চলে আসছি।

ফার্মগেটে একটি মেসে থাকেন শিউলি আক্তার। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। মাকে হারিয়েছেন চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। তিনি বলেন, ছোটবেলা বাবাকে হারিয়েছি। মাকে হারিয়েছি গত মাসে। স্বপ্ন ছিল একটি চাকরি করে মাকে নিয়ে ভালোভাবে দিন কাটাবো। কিন্তু চাকরি পাওয়ার আগে মাকেও হারাতে হয়েছে। মাস্টার্স শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটছি। থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় মাছ, মাংস খেতে পারি না। দাম কম থাকায় তখন খেয়েছি। গত বিশদিন ধরে মাছ, মাংস খাওয়া হয় না। মেসের জীবন আর ভালো লাগে না। টিসিবি থেকে একদিন তেল, ডাল, পিয়াজ, চিনি কিনেছি।

রেজাউল করিম বলেন, মিরপুরে একটি মেসে থাকি। একরুমে চারজন। আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। আগে দুই তিনটা টিউশনি করাতাম। লকডাউনের শুরু থেকে টিউশনিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। স্টুডেন্টের পরিবার অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। এদিকে কোর্টেও মাঝে মাঝে কাজ করতাম। করোনায় কোর্টও বন্ধ থাকে। নিজের খরচ চালাতে পারতাম না। এখন আবার কোর্টে কাজ শুরু করেছি। মাসে যে টাকা পাই তা যাতায়াতে সব চলে যায়। খাবারের খরচ আর থাকে না। কখনো কখনো ভাড়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ভালো কিছু করতেও পারছি না। অনেকদিন ধরে শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই বয়সে বাবার কাছে টাকা চাইতেও খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে জীবন নিয়ে হতাশায় পড়ে যেতে হয়। কয়েক বন্ধু মিলে এক সঙ্গে রান্না করে খাই। সবাই ভাগ করে টাকা দেই। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাসায় একবেলা রান্না হয়। সকালে যে যার মতো নাস্তা করে। দুইদিন আগে বাড়ি থেকে এক বন্ধুর মা গরুর মাংস পাঠিয়েছে। মনে হয়েছে কতোদিন পরে মাংস খেতে পেলাম। বাজার থেকে তো এখন মাংস কেনা আমাদের সম্ভব না।