আল্লাহর শোকর

আল্লাহর শোকর

আল্লাহর শোকর

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা ইসরা-৭০)
আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সূরা ত্বিন-৪) আমরা যদি শুধু এ নিয়ামতটির শোকর আদায় করতে সারা জীবন আল্লাহর গুণগান গাই, তবু কী আমাদের পক্ষে আল্লাহর শোকর আদায় করা কোনোভাবে সম্ভব হবে?

মহান আল্লাহ আমাদের দান করেছেন অসংখ্য-অগণিত নিয়ামত। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘ঈমান’-এর রৌশনিতে আমাদের জ্যোতির্ময় করেছেন। সাইয়িদুল মুরসালিন, প্রিয় নবীজী সা:-এর উম্মত হিসেবে কবুল সৌভাগ্যবান করেছেন। এগুলো সর্বোত্তম নিয়ামত। আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের ভূষণ ও পরিচায়ক। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করো, তবে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা নাহল-১৮)

শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন উত্তম গুণ। এটি সুন্দর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এ মহৎ কাজ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অধিক নিয়ামত বা অনুগ্রহ অর্জনে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আল্লাহ তায়ালা সমূহ সৃষ্টিকে মানুষের সেবা ও উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন। চাই মানুষ আল্লাহর অনুগত হোক বা অবাধ্য। আল্লাহপাক বলেন, ‘তিনিই সে সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা বাকারা-২৯)

অবশ্য আল্লাহর কাছে তাঁর কৃতজ্ঞ ও প্রিয় বান্দাদের জন্য পরকালীন জীবনে যা রয়েছে তা অনেক শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা, নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রুপা, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তার কাছে রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সূরা আলে ইমরান-১৪)
আল্লাহ তায়ালার দয়া-অনুগ্রহ যদি শুধু তার অনুগত বান্দাদের মধ্যে সীমিত থাকত, তবে এ পৃথিবী শুধু তার অনুগত বান্দাদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত, অকৃতজ্ঞরা বেঁচে থাকত না, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারও পেত না। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় মুসলিম-অমুসলিম, মুত্তাশিল্পাপী সবার জন্য তাঁর নিয়ামতরাজি ভোগ করার সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। পার্থিব জীবনে আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহ উন্মুক্ত, অফুরান। আর এ জন্যই তিনি রাহমান।

আমরা প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে ডুবে আছি, প্রতিনিয়ত এগুলোতে অবগাহন করছি। এসব নিয়ামত আমাদের কষ্টার্জিত নয়; আল্লাহর ইচ্ছায় না চাইতেই পেয়ে গেছি। তাই আমাদের বিবেক-হৃদয়ে টনক নড়ে না। আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবি না। অথচ আমরা যদি আল্লাহ প্রদত্ত কোনো একটা নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে গোটা জীবন সেজদায় পড়ে থাকি তবুও একটি নিয়ামতের জন্যও তা যথেষ্ট হবে না। আবার যদি শুকরিয়া আদায় না করি, তাতেও আল্লাহর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি তাকে পথ প্রদর্শন করেছি, এখন সে হবে শোকরকারী অথবা অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ইনসান-৩) আল্লাহর শোকরগুজারি এবং তাঁর নিয়ামতের বিষয়ে আমাদের চিন্তা-উপলব্ধি, আমাদের নিজের মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজন। যা উপরের আয়াত থেকে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। বরং জীবনে আরো অধিক হারে আল্লাহর অনুগ্রহ-নিয়ামত লাভের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের বিকল্প নেই। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দেন যে, তোমরা যদি (আমার নিয়ামতরাজির) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, তবে অবশ্যই অবশ্যই আমি (নিয়ামত) আরো বাড়িয়ে দেবো।’ (সূরা ইবরাহিম-৭)

বর্ণিত আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয়- ছোট-বড় প্রতিটি নিয়ামতের জন্য আল্লাহর দরবারে সন্তুষ্টচিত্তে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এতে আল্লাহ খুশি হবেন এবং আরো অধিক নিয়ামত দান করবেন। সুতরাং আমাদের উচিত আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতের জন্য অন্তর থেকে প্রাণভরে আলহামদুলিল্লাহ বলা এবং যথাযথভাবে সেগুলো কাজে লাগানো। স্মর্তব্য, কাজ-কর্মের দিক থেকেও কৃতজ্ঞতা রয়েছে। আর তা হচ্ছে- নিয়ামত সঠিকভাবে ভোগ করা বা উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা। যেমন- শক্তি, সুস্থতা ও ধন-সম্পদ ইত্যাদির জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি এগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করা এবং অপব্যবহার না করা। আর এটির সঠিক পন্থা হচ্ছে- আল্লাহর ইবাদত ও ভালো কাজ করা, পাপাচার-অনাচার থেকে পরিশুদ্ধ থাকা, সামর্থ্যানুযায়ী শক্তি-সম্পদ আল্লাহর পথে, সঠিক খাতে ব্যয় করা এবং কাজে লাগানো। অর্থাৎ, প্রতিটি নিয়ামত অনুযায়ী শারীরিক, মানসিক, আর্থিক- সব দিক থেকে শুকরিয়া আদায় করা। অন্যথায় আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেবো এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে, তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫)

ইসলামের শিক্ষা হলো- সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-দারিদ্র্য, সুস্থতা-অসুস্থতা তথা সর্বাবস্থায় শোকর গুজার থাকা। আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর যে কেউ অকৃতজ্ঞ হবে, সে জেনে রাখুক যে, আমার রব অভাবমুক্ত, মহানুভব।’ (সূরা নামল-৪০) আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, ‘অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা বাকারা-১৫২)

এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ ও নীতি হচ্ছে- ‘আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল’ অর্থাৎ সর্বাবস্থায় প্রশংসা শুধু আল্লাহর জন্য। এর তাৎপর্য হলো- সুখে পড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে না যাওয়া বরং সামগ্রিকভাবে শুকরিয়া আদায় করা এবং দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে হতাশ বা ধৈর্যহারা না হয়ে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এমন অবস্থার অনেক ফজিলতও রয়েছে। এমন মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন এবং নিয়ামত বা অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা-ই পছন্দ করেন।’ (সূরা জুমার-৭)আল্লাহর শোকর আদায় না করা বা অকৃতজ্ঞ হওয়া জঘন্যতম পাপ। এমন কাজের জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা (আমার নিয়ামতসমূহ) অস্বীকার করো, তবে জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আমার শাস্তির বিধান অবশ্যই কঠিন।’ (সূরা ইবরাহিম-৭)

সমাজ জীবনে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হই। সহযোগিতা, সহানুভূতি লাভ করি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে- উপকারী ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তার উপকার করা, কল্যাণকামী হওয়া এবং কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট থাকা। সাধ্যানুযায়ী, অনুরূপ বা উত্তম আচরণ করা। এগুলো আমাদের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব এবং কৃতজ্ঞতার দাবিও বটে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান-৪৪) রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাও আদায় করে না।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)

ইমদাদ ফয়েজি  : আলেম, কলেজ শিক্ষক