মারিউপোল দখলের দ্বারপ্রান্তে রাশিয়া!

মারিউপোল দখলের দ্বারপ্রান্তে রাশিয়া!

ছবি: সংগৃহীত

রুশ সৈন্যরা মার্চের গোড়ায় মারিউপোল শহরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফলতে শুরু করে এবং শহরের চারপাশে তাদের ফাঁস শক্ত করতে থাকে

রাশিয়া বলছে, পূর্ব ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে এক হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় মেরিন সেনা আত্মসমর্পণ করেছে, যদিও ইউক্রেন বলছে গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর শহর এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে। মারিউপোলের দখল নিয়ে রুশ এবং ইউক্রেনীয় সেনাদের মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তীব্র লড়াই চলছিল।

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই বন্দর শহরের ওপর রাশিয়া ছয় সপ্তাহ ধরে বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছে এবং রাশিয়া শহরটির পুরোপুরি দখল নেবার দ্বারপ্রান্তে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তবে মেরিন সেনাদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি নিয়ে পরস্পরবিরোধী দাবি শোনা যাচ্ছে। যদিও শহরটিতে আসলে কী ঘটছে তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা কঠিন।

এই মেরিন সৈন্যরা অ্যাজোভস্টাল নামে বিশাল যে ইস্পাত কারখানায় তাদের রক্ষণাত্মক অবস্থান তৈরি করেছিল, রয়টার্স-এর সাংবাদিকরা বলছেন সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।

এদিকে, রাশিয়ান টিভিতে দেখানো হয়েছে যে ইলিচ আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস নামের কারখানাটিতে এই সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছে।

তবে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা বলছেন এই মেরিন সৈন্যরা মারিউপোলের পতন ঠেকাতে মূল বাহিনী থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর একটি ছোট সেনা ব্যাটালিয়ান - অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ানের সাথে যোগ দিয়েছে।

ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলছে তারা এখনও শক্ত প্রতিরোধ বজায় রেখেছে এবং সেখানে যুদ্ধরত সৈন্যদের সাথে তাদের 'অনরবত যোগাযোগ' রয়েছে।

কারা এই অ্যাজোভ সেনাদল?
অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ান চরম দক্ষিণপন্থী একটি সেনা ইউনিট যারা এখন ইউক্রেন সশস্ত্র বাহিনীরই অংশ এবং ইউক্রেনের হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে।

এই ব্যাটালিয়ানের সৈন্য সংখ্যা এক হাজারেরও কম এবং তারা ইউক্রেন সশস্ত্র বাহিনীর ছোট একটি অংশ। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন লড়াই শুরু হবার পর থেকে তারা শিরোনামে রয়েছে। মারিউপোলে প্রতিরোধে তারা ইউক্রেনের হয়ে লড়ছে।

অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ানের নাম অ্যাজোভ সাগরের নামে, যে সাগরের তীরবর্তী শহর মারিউপোল। পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সালে চরম জাতীয়তাবাদী একটি মিলিশিয়া বাহিনী হিসাবে এই ব্যাটালিয়ানের উত্থান ঘটে। তবে এখন ইউক্রেনের জাতীয় রক্ষী বাহিনীর ছত্রছায়ায় তাদের নিয়ে এসেছে ইউক্রেন সরকার।

এই বাহিনীতে রয়েছে জাতীয়তাবাদী, চরম জাতীয়তাবাদী ও রাশিয়াবিরোধী অন্যান্য তরুণ সেনা সদস্য এবং এদের অনেকেই রুশ ভাষায় কথা বলে।

ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ এক হাজারের ওপর ইউক্রেনীয় মেরিন সেনার আত্মসমর্পণের রুশ দাবি অস্বীকার করে বলেছে, এরা ইউক্রেনের মূল সশস্ত্র বাহিনী ছেড়ে অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ানে যোগ দিয়েছে মারিউপোলের প্রতিরক্ষার জন্য অ্যাজোভ সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে।

মারিউপোল দখলের লড়াই
অ্যাজোভ যোদ্ধা ও মেরিন সেনারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ মারিউপোলের বিচ্ছিন্ন অংশ প্রতিরক্ষার জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু তাদের রসদও ফুরিয়ে এসেছে এবং রাশিয়ার তীব্র হামলার মোকাবেলা তাদের করতে হচ্ছে।

'এই মেরিন সৈন্যরা যদি গণহারে আত্মসমর্পণ করে থাকে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই,' বলছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক লেকচারার ড. আগলায়া স্নেতকফ।

'তাদের সরবরাহ ফুরিয়ে এসেছে, তাদের খাদ্য নেই, গোলাবারুদ ও পানি নেই - ইউক্রেনীয় সৈন্যরা অনলাইনে পোস্ট করেছে তাদের সামনে এখন দুটো পথ খোলা রয়েছে - হয় আত্মসমর্পণ করা নয়ত মৃত্যু মেনে নেয়া, কিন্তু কিয়েভ কর্তৃপক্ষ তাদের এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে,' বলছেন ড. স্নেতকফ।

তিনি বলছেন, এখন কয়েক হাজার অ্যাজোভ যোদ্ধাও যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তাহলে রুশ সেনাদের হাতে তাদের অবস্থা হবে "ভয়াবহ"।

'অনেককেই হত্যা করা হবে এবং অনেককে রুশ টিভির ক্যামেরার সামনে গিয়ে তারা কী করেছে তা বলতে বাধ্য করা হবে।'

"অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ান কার্যত শেষ হয়ে যাবে। ইউক্রেনে রুশ অভিযানের কারণ হিসেবে সবচেয়ে বড় যে যুক্তি রাশিয়ানরা দিয়ে আসছে তা হলো- এই 'নাৎসি'দের বিরুদ্ধে লড়া এবং তাদের শেষ করা।"

মারিউপোলের পতন রুশ বাহিনীর জন্য হবে গুরুত্বপূর্ণ একটা কৌশলগত অর্জন। মারিউপোলের পুরো দখল নিতে পারলে রাশিয়া হাজার হাজার সৈন্যকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে আবার মোতায়েন করতে পারবে এবং পরবর্তী হামলার পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি দিতে পারবে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির শীর্ষ উপদেষ্টা বলেছেন মারিউপোলের নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতে এবং শহরটির প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে ডনবাস এলাকায় প্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে আরও সৈন্য পাঠাচ্ছে।

লড়াইয়ের প্রথম পর্যায়ে রাশিয়ার বড় ধরনের ব্যর্থতার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পূর্ব ইউক্রেনে কৌশলগত 'বিজয়ের' ব্যাপারে আশাবাদী।

অন্যদিকে, মারিউপোলের পতন হলে সেটা ইউক্রেনের জন্য হবে একটা বিশাল ক্ষতি, কারণ ইউক্রেন মারিউপোল রক্ষার লড়াইকে এই যুদ্ধের একটা বড় কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বর্ণনা করেছে।

মারিউপোলের মেয়র বলেছেন দক্ষিণের এই শহরটিতে ২১ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গেছে এবং এক লাখ মানুষ এখনও শহর থেকে পালানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

'নিপ্রোর মর্গ রুশদের লাশে ভরে উঠেছে'
ইউক্রেনের নিপ্রো শহরের ডেপুটি মেয়র দাবি করছেন, তাদের হাসপাতালের মর্গগুলোতে আর জায়গা নেই, রুশ সৈন্যদের লাশে ভরে আছে।

মধ্য ইউক্রেনের এই শহরটির ডেপুটি মেয়র মিখাইল লাইসেঙ্কো বলেছেন মর্গের চারটি রেফ্রিজেটারের মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রুশ সৈন্যের লাশ রয়েছে।

তিনি বলছেন শহরের কর্মকর্তারা তাদের দাহ করতে বা কোনো গণকবরে তাদের কবর দিতে চাইছেন না।

তিনি রাশিয়াতে এসব সৈন্যর মায়েদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানিয়েছেন তারা যেন তাদের সন্তানদের সেনা কমান্ডারদের সাথে কথা বলেন যাতে তারা তাদের লাশগুলো ফিরিয়ে নিতে পারেন।

সূত্র : বিবিসি