বিদেশে কেন এতো বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে?

বিদেশে কেন এতো বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে?

ছবি: সংগৃহীত

প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরার সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশে। সরকারি হিসাবে গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া ২৭ হাজার ৬৬২ জন শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরত এসেছে।২০১৯ সালেও তিন হাজার ৬৫৮ জনের লাশ ফিরেছে দেশে, অর্থাৎ গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১০ জনের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরে এসেছে।বেশির ভাগের মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং স্বাভাবিক মৃত্যু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মৃত্যুর বড় কারণ কী?
বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকের মৃত্যুর হারও প্রতিবছর বেড়েছে।১৯৯৩ সালে মাত্র ৫৩ জন শ্রমিকের লাশ ফেরত এসেছিল প্রবাস থেকে, যে সংখ্যা ২০১৯ এ এসে হয়েছে তিন হাজার ৬৫৮ জন।সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বলছে, এই হিসাব কেবল যেসব লাশ ফেরত আসে সেই সংখ্যা ধরে।এর বাইরে অনেক লাশ সংশ্লিষ্ট দেশে দাফন করা হয়, যার হিসাব সব সময় হালনাগাদ থাকে না।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-পরিচালক জাহিদ আনোয়ার জানিয়েছেন, ‘যেসব প্রবাসীর লাশ ফেরত আসে দেশে, তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লাশের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে আসা ডেথ রিপোর্টে যা উল্লেখ থাকে, সেটিই জানা যায়। সেই হিসাবে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, স্বাভাবিক মৃত্যু এবং আত্মহত্যার কথা বেশি উল্লেখ থাকে। এর বাইরে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিদগ্ধ হওয়া এবং অসুস্থতার কারণও উল্লেখ থাকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে।’

২০১৯ সালে দেশে ফেরা লাশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে।নারী শ্রমিকসহ মোট ১১৯৮ জনের লাশ ফেরতে এসেছে দেশটি থেকে।সৌদি আরবে এই মুহূর্তে ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কাজ করেন।বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় অংশটি কাজ করেন সৌদি আরবে।

কেন হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক বেশি হয় শ্রমিকদের?
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যেঅল্পবয়েসী কর্মক্ষম মানুষ কাজে যাবার পরে কেন শ্রমিকদের দ্রুত এবং আকস্মিক মৃত্যু ঘটছে?

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটা প্রতিষ্ঠান, রামরু’র পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা যায়।সেখানে মূলত হৃদরোগ এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় পড়েন শ্রমিকেরা। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, প্রথম প্রথম অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তাপমাত্রা সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না।

‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে তীব্র গরম, তাতে প্রচণ্ড পানি শূন্যতা তৈরি হয়। সে অবস্থায় পানি বেশি পানের পাশাপাশি আরো কী করতে হবে সেটা বুঝতে না পেরে অসুস্থ হয়ে যান অনেকে। সে অবস্থায় কাজ করতে থাকলে হয় সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে, নতুবা কাজে মন দিতে পারবে না। উভয় ক্ষেত্রেই শারীরিক ক্ষতির সাথে মানসিক চাপ বাড়বে।’

‘আর অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি হবার কারণে শ্রমিকেরা ওখানে গিয়ে একটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন। হয়তো ঋণ নিয়ে বিদেশে গেছেন, কিন্তু কাজটি হয়তো খুবই অল্প বেতনের। তখন দ্বিতীয় একটি কাজ বা পার্টটাইম খোঁজে তারা। ফলে অনেকেই ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে পর্যাপ্ত ঘুমানোরও সুযোগ পান না, এতে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।’

মেরিনা সুলতানা বলছেন, সেই সাথে বৈধভাবে কাজের নিশ্চয়তা, দেশ থেকে যাবার সময় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা তুলে আনার তাগিদ এবং আত্মীয়-পরিজনহীন থাকার পরিবেশ, এসব কিছু মিলিয়ে তাদের স্ট্রেস বা মানসিক অনেক বেশি থাকে।

‘এছাড়া বাংলাদেশের শ্রমিকেরা বেশিরভাগ দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষতা নিয়ে যাবার কারণে নিম্ন মজুরীর কাজ করতে বাধ্য হয়। যে কারণে সেই রোজগারের মধ্যে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকে না বা তারা নিজেরাও সে খরচ করতে চায় না। যে কারণে দেখা যায়, হঠাৎ স্ট্রোক হলো বা হার্ট অ্যাটাক হলো।’সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালয়েশিয়াতে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন।এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা গেছে, বেশির ভাগ শ্রমিক হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন।

বাংলাদেশে যাচাই হয় না মৃত্যুর কারণ
সিলেটের হবিগঞ্জের মারুফ সরকার সৌদি আরব গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। চার বছর পর মারুফের মৃত্যুর খবর তার একজন রুমমেট ফোনে হবিগঞ্জে তার পরিবারকে জানিয়েছিলেন।

এক মাস পরে তার লাশ ফেরে দেশে। মারুফের বোন সালমা আক্তার জানিয়েছেন, লাশের সাথে আসা রিপোর্টে লেখা ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু, কিন্তু দাফন করার সময় পরিবারের সদস্যরা মারুফের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন।স্থানীয়ভাবে এ নিয়ে আলোচনা হবার পর যাদের মাধ্যমে মারুফ বিদেশে গেছেন, তারা পরামর্শ দেয় বিষয়টি নিয়ে ‘ঝামেলা’ না করে মেনে নিতে।

‘আমার আরেক ভাইরে কম টাকায় সৌদি নিয়া দিব বলছে, এই জন্য আমরা আর আগাই নাই। আমরা খালি বলছিলাম লাশটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে, কিন্তু কেউ শুনে নাই, মাটি দিয়া দিছে ভাইরে।’বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু তদন্তে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলছিলেন, ‘লাশের গায়ে ডেথ সার্টিফিকেটে যা লেখা থাকে, তাই সবাই জানে এবং মেনে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশেও যদি সেটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে স্বজনদের মনে কোনো সন্দেহ থাকতো না।’শরিফুল হাসান বলছিলেন, শ্রমিকদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ, তাদের স্বাস্থ্য এবং মৃত্যুর কারণ দেশে যাচাই না করলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে না।-সূত্র : বিবিসি