বাংলাদেশে সমুদ্র এলাকায় মেগাফনা সংরক্ষণের কাজ চলছে যেভাবে

বাংলাদেশে সমুদ্র এলাকায় মেগাফনা সংরক্ষণের কাজ চলছে যেভাবে

বাংলাদেশে সমুদ্র এলাকায় মেগাফনা সংরক্ষণের কাজ চলছে যেভাবে

বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্রসীমায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের জন্য দরকারি ইকো সিস্টেম রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা মেগাফনা সংরক্ষণের জন্য জেলেদের মধ্যে পরিচালনা করা হচ্ছে বিশেষ প্রশিক্ষণ।ইতোমধ্যেই প্রশিক্ষণ পাওয়া জেলেরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেও শুরু করেছেন বলে বলছেন গবেষকরা।নির্বিচারে মাছ ধরা ছাড়াও পানিদূষণসহ নানা কারণে বাংলাদেশের সীমানায় মেগাফনা বেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিলো।

মেগাফনা হলো বড় সামুদ্রিক প্রাণী যেমন হাঙ্গর, রে, সামুদ্রিক কচ্ছপ, সামুদ্রিক সাপ এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী - যেমন তিনি পরপয়েস ও ডলফিনের মতো প্রজাতির প্রাণীগুলো।এর মধ্যে সামুদ্রিক কচ্ছপের অবস্থা এখন বাংলাদেশে ঝুকিঁপূর্ণ এবং ডলফিন ও পরপায়েসের অবস্থা হুমকির মুখে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

ওয়ার্ল্ডফিশের মেগাফনা সংরক্ষণ প্রকল্পের  ফিশারিজ গভর্ন্যান্স বিষয়ক বিজ্ঞানী ড. হেদায়েত উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এসব প্রাণী সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতায় মূল ভূমিকা পালন করে।এরা সাধারণত দীর্ঘজীবি হলেও এদের প্রজনন হার খুব কম এবং সে কারণে বিশ্বজুড়েই এসব প্রাণীর সংখ্যা কমছে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ও ফিশারিজ অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ নেছারুল হক বলছেন বাংলাদেশের সমুদ্র কার্যত অরক্ষিত এবং একই সাথে সেখানে যারা মাছ ধরতে যায় তাদের সচেতনতার অভাবেই মেগাফনা বিশেষ করে সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যেভাবে চলছে সংরক্ষণের কাজ

ড. হেদায়েত উল্লাহ বলছেন, বিপন্ন হয়ে পড়া মেগাফনা সংরক্ষণে বাংলাদেশের কক্সবাজার, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনা উপকূলে এখন বিশেষ কর্মসূচি চলছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।এ কর্মসূচির আওতায় এক হাজারের বেশি জেলেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যাতে করে তাদের মাছ ধরার জালে অপ্রত্যাশিতভাবে এমন কোন প্রাণী আটকা পড়লে তার সাথে কী ধরণের আচরণ করতে হবে এবং তাকে কোন প্রক্রিয়ায় আবার সমুদ্রে ছেড়ে দিতে হবে।মূলত একজন মাঝির নেতৃত্বে পাঁচ থেকে পনের জনের ক্রু (যাদের ভাগী বলা হয়) কাজ করেন এবং এখানে কাজটির নেতৃত্ব দেন মাঝি নিজেই।চলতি বছরেই এজন্য তিনশর মতো মাঝিকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফিশের বিজ্ঞানীরা।

পাশাপাশি চল্লিশ জন মাঝিকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যারা এ বিষয়ে ‘নাগরিক বিজ্ঞানী’র ভূমিকা পালন করছেন।তারা সমুদ্রে অবস্থান করার সময় তাদের কার্যক্রম স্মার্টফোনের মাধ্যমে সরাসরি ক্যাচ মনিটরিং ডেটাবেইজে সরবরাহ করে থাকেন।অনেক সময়ই তারা বিপন্ন প্রজাতিগুলো জালে আটকা পড়লেও সেগুলোর বিশেষ যত্ন নিয়ে আবার সমুদ্রে ছেড়ে দিচ্ছেন।

“ছেড়ে দেয়ার আগে মাঝিরা দেখেন যে প্রাণীগুলো আঘাত পেয়েছে কি-না। তেমন কিছু দেখলে সেটা তারা রেকর্ড করে। পরে বিশেষ যত্ন নিয়ে তারপর প্রাণীগুলোকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে,” বলছিলেন ড. হেদায়েত উল্লাহ।এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষিত মাঝিদের কাছ থেকে যে হিসেব এসেছে তাতে চলতি বছরেই ২৪টি কচ্ছপ, একটি করে স্কেট, হাঙ্গর, ডলফিন ও পরপয়েস জেলেরা নিরাপদে ছেড়ে দিয়েছে।

হুমকিতে সামুদিক প্রাণীর ইকো সিস্টেম

বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকার এক লাখ আঠার হাজার বর্গকিলোমিটারেরও সামান্য বেশি এলাকাকে বলা হচ্ছে বিশেষ অথনৈতিক জোন।আর গবেষকদের মতে এটিই জীববৈচিত্র্যের বিরাট আধার।মাছ, প্রবাল, শৈবাল, মোলাস্ক, প্লাঙ্কটনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ এ অঞ্চলে থাকার কথা বলছেন তারা।বাংলাদেশের সরকার চলতি বছরের শুরুতে জানিয়েছিলো যে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত সমুদ্র এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির বেশ কিছু মূল্যবান উদ্ভিদজাত এবং প্রাণীজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

 প্রায় দু বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ২২০ প্রজাতির সি-উইড চিহ্নিত করা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিলো।আবার একসময় বঙ্গোপসাগরে প্রায় ২৭ প্রজাতির হাঙ্গর থাকলেও এখন তা সংখ্যায় অনেক কমে গেছে।এর কারণ হিসাবে অতিরিক্ত হাঙ্গর শিকার আর বাচ্চা হাঙ্গর ধরাকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা।

এভাবে মাছের জালে প্রাণীগুলো আটকে ফেলা ছাড়াও যদিও জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষনসহ নানা কারণে সামুদ্রিক ইকো সিস্টেম সমস্যার মুখে বলেও মনে করা হচ্ছে।যদিও সামুদ্রিক এ সব সম্পদ রক্ষায় সরকারী ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং ওয়ার্ল্ড ফিশ বলছে মেগাফনা সংরক্ষনের চেষ্টা তারই একটি অংশ।

এর আগে সরকার ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের প্রায় সতের হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা বা এমপিএ ঘোষনা করেছিলেন।এরপর ২০১৭ সালে নাফ নদী ও এর মোহনায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয় এবং ২০১৯ সালে নিঝুম দ্বীপ এলাকাকে এমপিএ ঘোষণা করে সরকারের মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়।তবে মোহাম্মদ নেছারুল হক বলছেন এসব ঘোষণার কার্যকর প্রয়োগ খুব একটা হয়নি বলে পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি।

“এগুলো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। তবে কয়েকটি সরকারি দপ্তর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আর কিছু বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। তবে সত্যিকার অর্থে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে মেগাফনাগুলো আসলেই চরম বিপন্ন হয়ে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,” বলছিলেন মিস্টার হক।  কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মেগাফনাগুলো হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি