ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়লে কার লাভ কার ক্ষতি?

ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়লে কার লাভ কার ক্ষতি?

ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়লে কার লাভ কার ক্ষতি?

বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ৬-৯ শতাংশ হারে যে সুদহার চলমান রয়েছে সেখান থেকে সরে এসে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।তারা বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ার প্রভাব খুব বেশি প্রতীয়মান হবে দুটি ক্ষেত্রে। একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি এবং আরেকটি বিনিয়োগ। এই দুই ক্ষেত্রেই সুদের হার বাড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তবে ব্যবসায়ী নেতারা অবশ্য বলছেন যে, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে এবং এই সময়ে সুদের হার বাড়ানো কোন ভাবেই উচিত হবে না।এর আগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার সময়ও শর্ত হিসেবে সুদের হার বাড়ানোর কথা বলেছিলে।দ্রব্যমূল্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবার পরেও সুদের হার বাড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এখনে সে অবস্থান পরিবর্তন করে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা আগামী জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বর্তমানে মুদ্রা বাজার পরিস্থিতির কারণে সুদের হারও ব্যাপকভাবে উঠানামা করছে। ফলে নির্ধারিত সুদ হার দিয়ে মুদ্রা বাজারের সাথে তাল মেলাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এজন্য সুদের হার পরিবর্তন করতে হচ্ছে।

 ‘মূল্যস্ফীতি কমবে’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার কম থাকলে ব্যাংক ঋণ নিতে আগ্রহী হয় গ্রাহকরা। ফলে কম সুদে ঋণ নিলে বাজারে অর্থের যোগান বাড়ে। কিন্তু ব্যাংকে আমানত বা সঞ্চয় বাড়ে না। ফলে দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতেই সুদের হার বাড়ানো হয়, যাতে ঋণ নিতে মানুষ কম আগ্রহী হয় এবং বাজারে অর্থের যোগান কমে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৭৮ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালের অগাস্টে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে রেকর্ড ৯.৫ শতাংশ হয়েছিল। এটি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

এর আগে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর ও এর আগে মে মাসে রেপো সুদহার (যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়) বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।এই মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার শর্ত সত্ত্বেও এতোদিন ব্যাংক ঋণের সুদের হার না বাড়িয়ে বরং তা ৯ শতাংশে নির্ধারিত করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সুদের হার বাড়লে তা আসলে পক্ষান্তরে মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রাখে।

তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লে ঋণের চাহিদা কমে যায়। আর ঋণের চাহিদা কমে গেলে সামষ্টিকভাবে চাহিদা কমে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির উপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।মি. হোসেন বলেন, ব্যাংকে যদি পর্যাপ্ত ঋণের সুবিধা থাকে তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। একই সাথে বাড়বে আমদানিও।উদোক্তারা বেশি ঋণ পেলে সেই ঋণ বেশি বিনিয়োগ করে যন্ত্রপাতি, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, সিমেন্ট, লোহার মতো কাঁচামাল আমদানির জন্য। ফলে এটি উৎপাদন ব্যবস্থাকে গতিশীল করে।আর সার্বিকভাবে উৎপাদন বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেয় বলে জানান তিনি।

বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিমত

বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বেড়েছে এবং দেশে মূল্যস্ফীতিও রয়েছে। গত ছয় মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এ পরিস্থিতির 'খেসারত' দিচ্ছেন। সুদের হার বাড়ানো হলে তাদের ব্যবসার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে তারা মনে করছেন।বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা বর্তমানে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছেন। সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৭২ শতাংশ। বিদ্যুতের দাম প্রতি সপ্তাহ বা প্রতি মাসে বাড়ছে। ব্যবসার গতি ধীর হয়ে এসেছে এবং ব্যয় সব দিক থেকে বাড়ছে।

“এরপর যদি আবার ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে যায়, তাহলে এটা আসলে মানে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা যেটা বলি আরকি আমরা সেরকম হবে।”সব ধরনের ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে তিনি মনে করেন, এই সময়ে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।এমন অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লে সেটি নতুন মাথাব্যথার কারণে হতে পারে এবং বিনিয়োগে স্বল্পমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সেটাও নির্ভর করবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এবং ব্যাংকের সাথে ঋণগ্রহীতার সম্পর্কের উপর।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, তারা আসলে প্রথমে ব্যাংকের চলমান খারাপ অবস্থার উন্নয়ন চান। এর পর ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা সুদের হার বাড়াতে চায় নাকি চায় না।বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

মি. রহমান বলেন, “আমি মনে করতে পারি আমার কস্ট অব ডিপোজিট যে পর্যায়ে আছে আমি আর ইন্টারেস্ট বাড়াবো না, হতে পারে। আমি হয়তো মনে করতে পারি এই কাস্টমারকে দিবো, এই কাস্টমারকে দিবো না, হতে পারে।”সুদের হার বাড়লে সেটি বিনিয়োগের উপর কী ধরণের প্রভাব ফেলে তা নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরণের যুক্তিই আছে। অনেকে অর্থনীতিবিদ বলেন, সুদের হার বাড়লে যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহণ করেন তাদের বাণিজ্যিক ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার যদি নয় শতাংশ নির্ধারণ করে রাখা হয় তাহলে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণদানে আগ্রহ হারায়। কারণ এ খাতে ঋণ দিতে গেলে তাদের ব্যয় বেশি হয় যা নয় শতাংশ সুদ দিয়ে পোষানো যায় না।বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এখন যদি এই দিকে ছাড় দেয়া হয় যে নয় শতাংশের বেশি সুদ নেয়া যাবে সেক্ষেত্রে অনেকের ক্ষেত্রে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকসেস বা ঋণের সুযোগ বাড়তে পারে।”“সেইটা যদি ঘটে তাহলে কিন্তু বিনিয়োগের উপর ইতিবাচক অর্থাৎ সুদের হার বাড়া সত্ত্বেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাই বেশি,” বলেন মি. হোসেন।

‘আমানত বাড়বে’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, এখন ব্যাংকগুলোর জন্য ডিপোজিট রেট বা আমানতের উপর সুদের হার বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর উপর চাপ আছে। তাদের পক্ষে সুদের হার নির্ধারিত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো নতুন করে কোন বিনিয়োগে যেতে চাচ্ছে না।তবে সুদের হার বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলো আরো বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবে এভং একই সাথে শিল্পক্ষেত্র তাদের পরিচালনার জন্য আরো বেশি মূলধন পাবে। এটা অর্থনীতির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। আর একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১.৭২ লাখ কোটি টাকা। তার মানে হচ্ছে ব্যাংক খাতে ঋণ যে হারে বেড়েছে সেই হারে আসলে আমানত বাড়েনি। ফলে তারল্য সংকটের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।তবে শুধু ঋণ বাড়ার কারণে নয় বরং, মূল্যস্ফীতি এবং মানুষের আয় না বাড়ার কারণে গ্রাহকদের সঞ্চয় কমে যাওয়া আমানত কমার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অনেকেই পুরনো সঞ্চয় ভেঙে খরচ করেছেন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সুদের হার বাড়ানো হলে সেটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক হবে। কারণ এর ফলে আমানতের সুদহারও বাড়বে বিধায় ব্যাংকের আমানত বা নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়বে।তিনি বলেন, এই মুহুর্তে সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে। ফলে ডিপোজিট বা আমানতের উপর বেশি সুদ দেয়া যাচ্ছে না। এর ফলে মানুষ ব্যাংকে আমানত না রেখে বেশি সুদের আশায় বিকল্প উপায়ে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকছে।

“এর ফলে আমরা ডিপোজিট হারাচ্ছি এবং দেখা যাচ্ছে যে মানি আউটসাইড ব্যাংক বাড়ছে।”তিনি বলেন, সুদের হার ৯ শতাংশ রাখায় শুধু ব্যাংক নয় বরং আমানতকারীরাও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে ঋণগ্রহীতারা।এক্ষেত্রে সুদের হার বাড়লে ডিপোজিট বা আমানত আরো বাড়বে। একই সাথে ঋণের সুদের হার বেড়ে সেটি যদি বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে সেটি ব্যাংকখাতকে উজ্জীবিত করবে বলে মনে করেন মি. রহমান।

সূত্র : বিবিসি