সংসদ সদস্য হলেও ফারুকের নায়ক পরিচয়টা ছিল মুখ্য

সংসদ সদস্য হলেও ফারুকের নায়ক পরিচয়টা ছিল মুখ্য

সংসদ সদস্য হলেও ফারুকের নায়ক পরিচয়টা ছিল মুখ্য

বাংলাদেশে অভিনেতা থেকে সরাসরি রাজনীতিতে নেমেছেন যে কয়েক শিল্পী, তাদের মধ্যে অন্যতম নায়ক ফারুক। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকার গুলশান এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তিনি মানুষের কাছে নায়ক হিসেবেই বেশি পরিচিত বলে তার সহকর্মীরা মনে করে।

চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালকরা বলেছেন, গ্রামীণ প্রতিবাদী চরিত্রে অভিনয়ে নায়ক ফারুক ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং সেটাই ছিল তার জনপ্রিয়তার বড় ভিত্তি।নায়ক ফারুক হিসেবে পরিচিত অভিনেতার পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান।

পুরান ঢাকায় শৈশব ও কৈশোর
ফারুক ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস গাজীপুরের কালিগঞ্জে। বাবা ছিলেন চিকিৎসক।২০১৬ সালের এক সাক্ষাৎকারে ফারুক বলেছিলেন, পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন তিনি।

এক সময় পাড়া-মহল্লায় নাটক বা কোনো অনুষ্ঠান পণ্ড করাই ছিল তার কাজ। ২০ টাকার বিনিময়ে ডিম ছুড়ে ভণ্ডুল করে দিতেন ওই সব আয়োজন।যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলায়, কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনেতা।

তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক সময় ভুলে যাই নিজেকে। কিছুক্ষণ পরে পকেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারি আমি একজন সাধারণ মানুষ।’ছাত্রজীবনে পুরান ঢাকায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ‘জলছবি’ নামের সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় আগমন ঘটে তার। ফারুক নামটি তাকে দেয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকী নাম হিসেবে।

সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামে নিজের এক বন্ধু মিলে দিয়েছিলেন নিজের পোশাকী ওই নাম।স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে তিনি অভিনয় করেন খান আতার পরিচালনায় ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমায়।এরপর তিনি ঢাকাই সিনেমায় অন্যতম একজন ব্যস্ত নায়ক হয়ে যান।

গ্রামীণ প্রতিবাদী চরিত্রে অনবদ্য এবং মিয়া ভাই খ্যাত ফারুক
নায়ক সোহেল রানা নামে পরিচিত চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেছেন, গ্রামীণ প্রতিবাদী চরিত্রের অভিনয়ে নায়ক ফারুকের অবস্থানে এখনো কেউ আসতে পারেনি।

তিনি আরো বলেছেন, ‘’আমার কাছে যেটা মনে হতো, সেটা আমি বলেছি ওকে (অভিনেতা ফারুক)। যদিও সে (ফারুক) আমাকে বলেছে, ‘পারভেজ ভাই, আপনি হয়তো আমার সব ছবি দেখেননি।’’নায়ক সোহেল রানা বলেন, ‘তবে আমি যতটুকু দেখেছি এবং জনসাধারণের পালস যতটুকু বুঝি, তা হচ্ছে- গ্রামীণ এবং প্রতিবাদী চরিত্র যদি হতো এবং সেটা যদি ন্যায়ের পক্ষের হয়, তাহলে ওই চরিত্রে ফারুক অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং তুলনাহীন শিল্পী।’

অভিনেতা ফারুক ৭০-এর দশকে ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় লাঠিয়াল চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সারেং হয়েছেন ‘সারেং বৌ’ সিনেমায়, আবার রোমান্টিক প্রেমিকের চরিত্রে সুজন সেজেছেন ‘সুজন সখী’ সিনেমায়।‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘আলোর মিছিল’, ‘নয়নমনি’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘সূর্য গ্রহণ’-এমন অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ও লেখক অনুপম হায়াৎ বলেছেন, অভিনেতা ফারুকের অভিনীত ছবিগুলো ব্যবসায়িক সফলতাও পেয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মাপকাঠিতে ফারুকের অভিনয় ও শিল্পীসত্ত্বা একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।’অভিনেতা ফারুকের অভিনয়ের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’তে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন কবরী।এরপর তিনি কবরী, সূচন্দা, ববিতা ও রোজিনাসহ অনেকের সাথে বিভিন্ন সময় জুটি বেধে অভিনয় করেছেন।

ফারুক কেবল নায়ক চরিত্রে পর্দায়ই জনপ্রিয় ছিলেন না, সহকর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়।চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রোজিনা বলেছেন, ফারুক কেবল অভিনয়ে একজন বড় শিল্পী ছিলেন না, তিনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনেক বড় মাপের।তিনি বলেন, ‘তিনি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সবার কাছে ছিলেন মিয়া ভাই, সবাই তাকে মিয়া ভাই বলে ডাকতাম। আমাদের শিল্পের কারো কোনো সমস্যা হলেই তিনি সাহায্যে এগিয়ে আসতেন।’

রাজনীতিবিদ ফারুক
অভিনেতা ফারুক ছাত্রজীবনে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ওই সময় মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছিল বলে তার পারিবারের এক সদস্য জানিয়েছে।তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে বড় পর্দায় অভিনয়ে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে। তিনি সরাসরি রাজনীতিতে নেমে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে এমপি হন আওয়ামী লীগ থেকে।অনুপম হায়াৎ বলেছেন, রাজনীতির মাঠে এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি রাজনীতির মাঠে ঠিকভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে পারেননি।অভিনেতা ফারুক অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আজীবন সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।

সূত্র : বিবিসি