সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় নাগরিক নিহত!

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় নাগরিক নিহত!

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় নাগরিক নিহত!

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন এক ভারতীয় নাগরিক। নিহত ব্যক্তিকে ‘গরু পাচারকারী’ বলে অভিহিত করেছে বিএসএফ। একথা জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।

নিহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, রাতে শৌচ করার জন্য ঘরের বাইরে বের হতেই বিএসএফ তাকে গুলি করে এবং সেখান থেকে লাশ টেনে নিয়ে সীমান্তের পাশে ফেলে আসে।ঘটনাটি ঘটেছে কোচবিহার জেলায় শুক্রবার রাতে এবং নিহত ব্যক্তির নাম গৌতম বর্মণ।কোচবিহার জেলার কুচলিবাড়ি থানায় যে লিখিত ঘটনাক্রম জমা দিয়েছে বিএসএফ, সেটি সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন জেলার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট সুমিত কুমার।

লিখিত বক্তব্যে বিএসএফ বলেছে, ‘অর্জুন সীমান্ত চৌকিতে প্রহরারত বিএসএফ সদস্যরা রাত পৌনে ১টার দিকে কিছু দুষ্কৃতিকারীর চলাচল লক্ষ্য করে, তাদের সাথে গরু ছিল, যেগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছিল। বিএসএফ সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে, কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা ধারালো এবং ভোঁতা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে, তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।’

কুচলিবাড়ি থানায় জমা দেয়া লিখিত বক্তব্য উদ্ধৃত করে কোচবিচারের পুলিশ সুপার সুমিত কুমার সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, ‘বিএসএফ সদস্যরা পিএজি থেকে এক রাউন্ড গুলি চালায়। পরে তল্লাশির সময়ে কাঁটাতারের বেড়াবিহীন একটি এলাকায় মাথায় গুলিসহ এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির দেহ বিএসএফ সদস্যরা দেখতে পান। তার পাশে দুটি গরু, একটি দা এবং কিছু বাঁশের লাঠি পাওয়া গেছে। বিএসএফ তাদের নিজস্ব পুরুষ নার্সকে ডেকে পাঠায়, এবং তিনি দেহটি পরীক্ষা করে জানান যে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন।

পাম্প অ্যাকশন গান, যেটি সাধারণভাবে মারণাস্ত্র নয়, কিন্তু খুব কম দূরত্ব থেকে ওই বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলিও মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে বিএসএফ দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে।পুলিশ জানিয়েছে, পরে ওই ব্যক্তিকে ফুলকাডাবরি গ্রামের বাসিন্দা গৌতম বর্মন বলে শনাক্ত করেন তার আত্মীয়রা।

পরিবারের বক্তব্য ভিন্ন
নিহতের এক ভাই শ্যামল রায় জানিয়েছেন, গৌতম বর্মন কোনোভাবেই গরু পাচারের সাথে যুক্ত নন, তিনি কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন এবং সম্প্রতি বাড়ি এসেছিলেন।

‘বৃহস্পতিবার আমার মাসতুতো (মামাতো) ভাই আমার মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। তখন আমাদের রাতের খাওয়ার সময়। তাই মা তাকে খেয়ে যেতে বলেছিল। গৌতম তাতে রাজি হয়, তবে বলে সে একটু টয়লেট থেকে আসছে। এই বলে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল, তার পরেই আমরা গুলির আওয়াজ পাই। তখন আনুমানিক ১০টা হবে রাত,’ বলেন শ্যামল রায়।

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই বাড়ির এত কাছে গুলির আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে যাই। কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমরা লাইট জ্বালিয়ে আশপাশে কিছুই দেখতে পাইনি। এদিকে ভাইও বাড়ি ফেরেনি। শুক্রবার ভোরবেলায় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে একেবারে সীমান্তে ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাই। এদিকে আমাদের বাড়ির কাছে গুলির ফাঁকা খোল, রক্ত পড়েছিল।’শ্যামল রায় বলেন, তাদের বাড়ির সামনে ভাইকে গুলি করে মেরে লাশ টেনে নিয়ে গিয়ে সীমান্তে ফেলে দিয়ে তাকে গরু পাচারকারী বলে চালাচ্ছে বিএসএফ।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে ফুলকাডাবরি গ্রামে গিয়েছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমিত ভার্মা। তিনি জানিয়েছেন, বিএসএফের বক্তব্য তাদের কাছে জমা পড়েছে, পরিবারের পক্ষ থেকেও তাদের বক্তব্য থানায় লিখিত আকারে জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে আর লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।

দুই বছরে ১০ ভারতীয় নিহত
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কোচবিহার জেলার অংশে এ নিয়ে গত দু’বছরে ১০ জন ভারতীয় নাগরিক বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারালেন।প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিএসএফ বলে এসেছে যে নিহতরা গরু পাচারের চেষ্টা করছিলেন, তাদের সেই কাজে বাধা দেয়ায় পাচারকারীরা বাহিনীর সদস্যদের আক্রমণ করেন, তখন আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে হয়।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে সরব মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের প্রধান কিরীটী রায় বলেন, ‘যদি ধরেও নিই যে এই গৌতম বর্মন বা তার মতো আরো যেসব ভারতীয় নাগরিক বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন, তারা গরু পাচারকারী, কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের আটক না করে গুলি কেন চালাচ্ছে? কে পাচারের কাজে দোষী বা নির্দোষ, সেই বিচার করার অধিকার কে দিয়েছে বিএসএফকে? সন্দেহভাজন পাচারকারীকে তো গ্রেফতার করে বিচারের জন্য পাঠানোর কথা।’

‘আরো অনেক ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখি যে মাথায় গুলির চিহ্ন, এখানেও সেই একই ঘটনা। ভারতীয় আইন অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীকে নিতান্তই গুলি চালাতে হলে পায়ে গুলি করার নিয়ম, কিন্তু মাথায় গুলি করার অর্থ হত্যা করার জন্যই গুলি করা হচ্ছে,’ বলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের যে অংশ আছে, সেখানে গুলি চালানো কমে এলেও কোচবিহার জেলাতে সেই মৃত্যু কিছুতেই থামছে না।গৌতম বর্মনের আগে এই জেলায় গত দুবছরে অন্তত ৯ জন ভারতীয় নাগরিক বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন।

মাছ ধরতে গিয়ে গুলি
কোচবিহারের গিতালদহ অঞ্চলের বাসিন্দা বিলকিস বিবির স্বামী মোফাজ্জল হোসেন বাড়ির কাছে বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন প্রতিদিনের মতোই। সেটা ছিল ২০২২ সালের ২৯ জুন।সেই রাতে তিনি গুলির শব্দ পেয়েছিলেন, কিন্তু কল্পনাও করেননি যে ওই গুলিটা তার স্বামীর মাথা তাক করে চালানো হয়েছিল।

‘দুপুরের দিকে আমার স্বামীর দেহ ভাসতে দেখা যায় ওই বিলের জলেই। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। তখনই আমার খেয়াল হয় যে রাতে আমি একটা গুলির আওয়াজ পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি সেটা আমার স্বামীর মাথায় গুলি করার আওয়াজ,’ বলেন বিলকিস বিবি।

মোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধেও বিএসএফের অভিযোগ ছিল যে তিনি আসলে একজন পাচারকারী।কিরীটী রায় বলেন, কোনো মৃত্যুর ক্ষেত্রেই সঠিক তদন্ত হয় না, ক্ষতিপূরণ পান না নিহতের পরিবার।শুধু যে ভারতীয় নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসছে, তা নয়।কোচবিহার জেলার সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন বিএসএফের অত্যাচার তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনকি তারা কী চাষ করতে পারবে কাঁটাতারের বেড়ার অন্যদিকে থাকা চাষের জমিতে, সেটাও বিএসএফই ঠিক করে দেয়।সীমান্তের বাসিন্দারা অনেকেই এখন চাইছেন কাঁটাতারের বেড়ার অপরদিকে থাকা তাদের জমি সরকার নিয়ে নিক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে, তাহলে তারা নিত্য অত্যাচারের হাত থেকে অন্তত বাঁচতে পারবেন।

সূত্র : বিবিসি