অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনার মূল কারণ

অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনার মূল কারণ

ফাইল ছবি।

পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে সড়কপথে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করেছে এই ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক।রাজধানী ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হয়েছে। গত এক বছরে এক্সপ্রেসওয়েটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

শনিবার (২৪ জুন) এ মহাসড়কে প্রাণ যায় আটজনের। ভাঙ্গার মালিগ্রাম ফ্লাইওভার এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা খেলে সেটিতে আগুন ধরে যায়। এর কয়েক মাস আগে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহনের বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে ছিটকে পড়লে প্রাণ হারান ১৯ জন।

জানা গেছে, প্রকল্পের অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩১ দশমিক ৭ কিলোমিটার, পুরান ঢাকার বাবুবাজার সেতু থেকে কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া পর্যন্ত ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার লিংক রোড, পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মোট ৫৫ কিলোমিটার সড়ক চার লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। মহাসড়কের দুই পাশে ধীরগতির যান চলাচলের জন্য রয়েছে সাড়ে পাঁচ মিটার প্রশস্ত পৃথক লেন। মহাসড়কের মাঝ বরাবর আছে পাঁচ মিটার প্রশস্ত ‘মিডিয়ান’।

এই মহাসড়ককে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে বলা হচ্ছে, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন যান চলাচল করার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে দেখা গেছে, অতিরিক্ত গতি, নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার না হওয়া এবং যানবাহনের ফিটনেস না থাকায় এ মহাসড়কে রক্ত ঝরছে। ১৯ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বুয়েট যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সেখানে বলা হয়- এক্সপ্রেসওয়ের পাশে ‘গার্ড বেইল’ বা নিরাপত্তা বেষ্টনি না থাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে। নিম্নমানের টায়ার ব্যবহারকেও সেখানে দায়ী করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, একাধিক ট্রিপ ধরার জন্য বাসচালকরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালান। অনেক সময় গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের তরফ থেকেও চাপ থাকে।

বাঁধের মতো দেখতে মহাসড়কটি মাটি থেকে প্রায় আট ফুট উঁচুতে। নিয়ম অনুযায়ী, এমন সড়কে নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকা বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকলে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি কম হতো। এমন সড়কে ঝুঁকি বিবেচনায় ‘ডাব্লিউ বিন’ (নিরাপত্তা বেষ্টনী) রাখার কথা। ‘ডাব্লিউ বিন’ হচ্ছে এক ধরনের ঢেউ তোলা টিনের পাত। তবে এতে দুটি ঢেউ থাকে বলে দেখতে ইংরেজি ডাব্লিউ বর্ণের মতো দেখায়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, মহাসড়কে এ জাতীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী বেশি কার্যকর।

এক্সপ্রেসওয়ের মতো সোজা পথ দুর্ঘটনার জন্য বেশি বিপজ্জনক- এমন তথ্য উঠে এসেছে এআরআইয়ের এক গবেষণায়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৮৪ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। আর বাঁকের চেয়ে সোজা পথে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সোজা পথে দুর্ঘটনা ঘটে ৬৭ শতাংশ।

মহাসড়কটি নির্মাণের আগে ও পরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে কোনো নিরীক্ষা হয়নি। মানা হয়নি ২০০৫ সালে তৈরি করা নিরাপত্তা মডিউলও। এ জাতীয় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে নকশা তৈরির আগে প্রাক-নিরাপত্তা নিরীক্ষা করার কথা। প্রকল্পের নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার আগে আবার নিরাপত্তা নিরীক্ষা জরুরি। কিন্তু তা হয়নি। এখন নিরাপত্তা বেষ্টনি দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনাটি সম্ভবত ঘটেছে অতিরিক্ত গতির কারণে। তদন্তে বিস্তারিত জানা যাবে। এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটে। তাই আমরা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন- সিসি ক্যামেরা স্থাপন। এতে অনেকগুলো সুফল মিলবে; গাড়ি গতিসীমা তাৎক্ষণিক জানা যাবে। কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তাও দেখা যাবে। আর এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় উদ্ধারকারী টিম থাকবে সব সময়।

জানা গেছে, এই এক্সপ্রেসওয়ের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু বেশির ভাগ গাড়ি আরও বেশি গতিতে চলে। হাইওয়েতে যতো মামলা হচ্ছে, তার ৪৫ শতাংশই হচ্ছে গতিসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে।

হাইওয়ে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এই মহাসড়কে দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৮টি, যাতে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৫৫ জন। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটে। এই মহাসড়কে যেসব যানবাহন চলাচল করবে, সেগুলোর ফিটনেস ঠিক আছে কিনা, মহাসড়কের গতিসীমার সঙ্গে তাল রেখে চলতে সক্ষম কিনা ইত্যাদি বিষয় যাচাই করা হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা থাকলে ত্রুটিগুলো খুঁজে পেতে সুবিধা হয় এবং সেগুলো সংশোধন করা যায়। তা ছাড়া মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা ২০২১-এর খসড়ায় বলা আছে, রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে। মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীদের নিয়মিত পরিদর্শন অপরিহার্য বলে গণ্য হবে।

হাসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি এস এম রাশেদুল ইসলাম বলেন, চালকদের অসাবধানতার কারণেই বেশির ভাগ সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা গতিসীমা মানছেন না; যত্রতত্র ওভারটেকিং করছেন। পর্যাপ্ত ফ্লাডলাইট না থাকা এবং পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।