আওয়ামী লীগের জন্য ১৪ দলীয় জোট এখন আর কতটা প্রয়োজনীয়?

আওয়ামী লীগের জন্য ১৪ দলীয় জোট এখন আর কতটা প্রয়োজনীয়?

আওয়ামী লীগের জন্য ১৪ দলীয় জোট এখন আর কতটা প্রয়োজনীয়?

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বুধবার সন্ধ্যায়। এ বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা হবে বলে আশা করছেন জোট নেতাদের অনেকে।এ জোটের বৈঠক এমন সময় হতে যাচ্ছে, যখন আগামী নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের পাশাপাশি দেশের ভেতরেও ‘সরকারের পদত্যাগের এক দফা’ দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।

এমন প্রেক্ষাপটে ১৪ দলের নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। যদিও ১৪ দলের মধ্যে মাত্র চারটি দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এবং বেশিরভাগ দলেরই ভোটের পরিসংখ্যানে খুব একটা শক্ত অবস্থান দেখা যায় না।বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারের পদত্যাগের পর একটি নির্দলীয় সরকার ছাড়া অন্য কিছু তারা গ্রহণ করবেন না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগও পাল্টা বলেছে যে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই তারা নির্বাচন করবে এবং এটি ছাড়া আর কিছু তারাও গ্রহণ করবে না।এদিকে সরকার ও বিরোধী দলের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই প্রাক নির্বাচনী পরিবেশ মূল্যায়নের কাজ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার ঢাকা সফরকালেও নির্বাচন ইস্যুটি গুরুত্ব পেয়েছিলো।

যুক্তরাষ্ট্র এর আগেই নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে রেখেছে। এই নীতির আওতায় যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সেদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় - তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন।মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতি অনুযায়ী নতুন এ নীতির আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা।

'আমাদের মিল আছে'

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের জন্য ১৪ দল কতটা প্রয়োজনীয় কিংবা কোনো গুরুত্ব বহন করে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেছেন এ জোট আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

“এই জোটের প্রয়োজনীয়তা আগেও ছিলো, এখনো আছে। কারণ প্রথমত আমরা সবাই সমমনা দল এবং তাদের নীতির সাথে আমাদের মিল আছে। সবসময় হয়তো আমরা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারি না কিন্তু জাতীয় ইস্যু বা প্রয়োজনে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার গুরুত্ব আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী জোট নেতাদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছেন”।যদিও প্রধানমন্ত্রী এই জোটের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক করেছিলেন গত বছরের মার্চে। এর আগে তিনি এই জোটের সাথে শেষ বৈঠক করেছিলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে।

এর আগের মন্ত্রীসভায় জোটের শরীক দলগুলোর কয়েকজন নেতা স্থান পেলেও চলতি মন্ত্রীসভায় জোটসঙ্গীদের কাউকে রাখেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়েও ১৪ দলের অভ্যন্তরে অসন্তোষও আছে।কাজী জাফর উল্লাহ বলছেন, “অসন্তোষ থাকতেই পারে। এটি আপেক্ষিক। কারণ আমরা মনে করি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ ভাবতে পারে যে যথেষ্ট করা হয়নি। রাজনীতিতে এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ যে জোটসঙ্গীদের গুরুত্ব দেয় সেটি সবসময়ই প্রমাণিত”।তবে এসব পাওয়া – না পাওয়াকে এখন আর গুরুত্ব দিতে রাজী নন ১৪ দলের অন্যতম শরীক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার মতে এখন চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিই তাদের সব পক্ষের কাছে মূল বিবেচ্য বিষয়, কারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও এক হচ্ছে।

“প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন এবং আমরা যাবো। আশা করছি রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা আমাদের মতামত দিবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ১৪ দলীয় জোটের শরীক অন্য দলগুলো হলো-সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাসদ (ইনু), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ, তরিকত ফেডারেশন এবং জেপি।

'ছোট-বড় সবাইকেই সবার দরকার'

সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া বলছেন প্রায় দুই দশক ধরে কিছু অভিন্ন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট দাঁড়িয়ে আছে এবং জোটের রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণেই সেটি সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

“আমাদের মূল ভিত্তি হলো -মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তার ভিত্তিতেই দেশ চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা। সামনে নির্বাচনেও সেটি প্রতিফলিত হবে। সে কারণে জোটের গুরুত্ব সব পক্ষেই আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।অন্যদিকে জোটের আরেক শরিক তরিকত ফেডারেশনের প্রধান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলছেন জোটটি আওয়ামী লীগের যেমন প্রয়োজন আবার জোট শরিকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

“শুধু নির্বাচন নয়। দেশের উন্নয়নের জন্যও যে ঐকমত্য দরকার সেক্ষেত্রেও জোটের ভূমিকা আছে। আমরা সবাই দেশকে এগিয়ে নিতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চাই। ফলে এখানে বড় ছোট-বড় সবাইকেই সবার দরকার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।কিন্তু জোট শরীকদের ভোটের মাঠে দুর্বল অবস্থানের কারণে এ জোট নিয়ে সামনে নির্বাচনে কতটা লাভ হবে আওয়ামী লীগের- সে প্রশ্ন সবসময়ই আছে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা সবসময়ই মনে করেন সমমনা দলগুলো এক থাকলে নির্বাচনের মাঠে সেটি এক ধরণের শক্তি হিসেবে কাজ করে।

এছাড়া জোট শরীকদের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী কিছু দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে সুসম্পর্ক আছে, সেগুলোও রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অনেক সময়।আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন ১৪ দল নির্বাচনী জোট এবং এখানে কার কত ভোট তার চেয়ে বড় বিষয় হলো এই শক্তি এক থাকলে মানুষ আস্থা ও ভরসা পায়।

“দেশের মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নে সমমনা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। এ জোটের গুরুত্ব আছে প্রয়োজন আছে। মানুষ শান্তিপ্রিয় ও উন্নয়নপ্রিয়। অগ্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাছে আদর্শই বড়। সেটিই গুরুত্বের জায়গা। গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই তাদের ভোট যাই হোক তাদের গুরুত্ব নেই”।

তবে এ সত্ত্বেও ১৪ দলের অভ্যন্তরে অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগ এতোদিন এই জোটের প্রতি একটি ‘গা-ছাড়া’ ভাব দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জোটে থাকা দলগুলোর মূল্যায়নও সঠিকভাবে হয়নি -এমন মতও আছে অনেকের।কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রী সভা আহ্বান করায় এসব বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ১৪ দলীয় জোটের নেতারা।

সূত্র : বিবিসি