বিরোধীশূন্য লোকসভায় অনাস্থা ভোটে মোদির জয়

বিরোধীশূন্য লোকসভায় অনাস্থা ভোটে মোদির জয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

মণিপুরে চলমান জাতিসংঘর্ষ ইস্যুতে ভারতের লোকসভায় আনা বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব ভালোভাবেই উতরে গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে মোদি বক্তৃতা দেয়ার পর সরকারদলীয় এমপিদের কণ্ঠভোটে খারিজ হয়ে যায় এই প্রস্তাব।

বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) বিকেলে ভাষণ দিতে গিয়ে শুরু থেকেই বিরোধীদের চড়া সুরে আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী। জানিয়ে দেন, ‘অনাস্থা প্রস্তাব ঈশ্বরের আশীর্বাদ।’ এরপর একটানা দেড়ঘণ্টার বেশি বিরোধী বিশেষ করে রাহুল গান্ধীর ভাষণের পয়েন্ট ধরে ধরে উত্তর দিকে থাকেন মোদি।

নরেন্দ্র মোদির এমন ভাষণ বিরোধী জোটের পছন্দসই না হওয়ায় অধিবেশনে চলাকালে হই হট্টগোল শুরু করেন ইন্ডিয়া জোটের সংসদ সদস্যেরা। এ সময় বিরোধী বেঞ্চ থেকে একাধিকবার ‘মণিপুর, মণিপুর’ ধ্বনি শোনা গিয়েছে সংসদে। একসময় প্রায় দেড় ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাখা হয়ে গেলেও মণিপুর ইস্যুতে একটি বাক্য খরচ না করে শুধুমাত্র বিরোধীদের আক্রমণ শানাতে থাকায় এরপর বিরোধী সদস্যরা ওয়াকআউট করেন। বিরোধীরা ওয়াকআউট করতেই মণিপুর নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী।

ভারতের জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্য মণিপুরে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় সরকার গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে অভিযোগ তুলে সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো।

টানা তিন দিন এই প্রস্তাব নিয়ে বিজেপি ও বিরোধীদলীয় এমপিদের পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক শেষে বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) এই ইস্যুতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বক্তব্য দেন নরেন্দ্র মোদি।

নিজের ভাষণে এদিন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে আক্রমণ করতে গিয়ে মোদি সবচেয়ে বেশি কটাক্ষ করেন কংগ্রেসকে। রাহুলের ‘মহব্বত কি দুকান’ মন্তব্যকে এদিন খোঁচা মেরে মোদি বলেন, ‘ওরা বলছে, আমরা ঘৃণার দোকান এবং ওরা ভালবাসার দোকান। কিন্তু ওদের দোকান লুটের আর বাজার মিথ্যের। ওদের দোকানে শিগগিরই তালা পড়বে। ওরা ভারতের দেউলিয়া হওয়ার গ্যারান্টি। কিন্তু আমরা দেশকে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তুলব।’ এ সময় রাহুল গান্ধীর ‘অহংকারী রাবণ’ মন্তব্যের জবাবে পাল্টা দেন মোদি। কথার অনুষঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘লঙ্কাকে রাবণের অহঙ্কার ডুবিয়েছে এটা ঠিক কথা, যেমন কংগ্রেসকেও ডুবিয়েছে। রামরূপী জনতা ৪০০ থেকে ৪০-এ নামিয়ে এনেছে ওদের।’

নিজ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মণিপুরের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই যে পুরো দেশ তাদের পাশে রয়েছে এবং দ্রুত সেই রাজ্যে শান্তি ফিরে আসবে।’

উল্লেখ্য, গত ৩ মে মণিপুরের হিন্দু ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠী মেইতিদের সাংবিধানিকভাবে তফসিলি জাতির স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেন রাজধানী ইম্ফলের হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এই সুপারিশ জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংঘাত শুরু হয় মেইতি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে।

বিজেপিশাসিত মণিপুরে দাঙ্গা থামাতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর রিজার্ভ ফোর্স পাঠানো ব্যতীত এতদিন দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। গত দুই মাসের দাঙ্গায় অন্তত ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি মানুষ। সেই সাথে ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর, গির্জা, মন্দির ও সরকারি স্থাপনা, বাড়ি-ঘর ছেড়ে মিজোরাম, আসাম ও নিকটবর্তী অন্যান্য রাজ্যের আশ্রয়শিবিরগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ।

গত ১৯ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীর তিন নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটতে বাধ্য করেছে একদল দাঙ্গাকারী। ওই নারীদের মধ্যে একজন গণধর্ষণেরও শিকার হয়েছিলেন।

এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরদিন, ২০ জুলাই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রথমবারের মতো মণিপপুর ইস্যুতে মুখ খোলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু মোদি বক্তব্য দেয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি নিতে থাকে কংগ্রেস ও বিরোধী দলগুলো এবং সোমবার ছিল তার শেষ ধাপ। আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হয় মোদি ও তার নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে।

বৃহস্পতিবারের বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মণিপুরে বেশ কয়েকজন নারী গুরুতর অপরাধের শিকার হয়েছেন। অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে কেন্দ্র ও মণিপুর রাজ্য সরকার সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমি ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, মণিপুরে শিগগিরই শান্তি ফিরে আসবে এবং এই রাজ্য আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে।’

‘আমি মণিপুরের নারীদের আরো বলতে চাই যে, পুরো দেশ তাদের পাশে রয়েছে। যে সঙ্কট মণিপুরকে এই অবস্থার দিকে পরিচালিত করেছে, পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হলে তারও সমাধান হবে।’