ভ্যাট আদায়ে কীভাবে কাজ করবে ইএফডি, কতটা সফল হবে?

ভ্যাট আদায়ে কীভাবে কাজ করবে ইএফডি, কতটা সফল হবে?

ভ্যাট আদায়ে কীভাবে কাজ করবে ইএফডি, কতটা সফল হবে?

বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট আদায়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় কাজ করার একটি পদ্ধতি উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি সিস্টেমের ফলে ভ্যাট আদায় নিয়ে অস্বচ্ছতা কেটে যাবে বলে দাবি করছেন কর্মকর্তারা।এছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাটের হিসাব সরাসরি সরকার জানতে পারবে।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে মূসক ব্যবস্থা চালু হলেও এটি আদায় নিয়ে বরাবরই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে মূসক আদায় করা হলেও সেটি সরকারি কোষাগারে ঠিকমতো জমা পড়ছে না। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট আদায় নিয়ে স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে অভিযোগ উঠেছে।মঙ্গলবার উদ্বোধন করা স্বয়ংক্রিয় এই ব্যবস্থা সেসব চ্যালেঞ্জ কতটা দূর করতে পারবে?

ইএফডি পদ্ধতি কী?

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শাহনাজ চৌধুরী ধানমণ্ডির একটি রেস্তোরায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতের খাবার শেষে যখন বিলের কথা জানতে চান, রেঁস্তোরার ওয়েটার একটি সাদা কাগজে মোট বিলের অংশ লিখে টেবিলে দিয়ে যান। সেখানে খাবারের খরচের সাথে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও যোগ করা হয়েছে। তিনি যখন ইসিআর মেশিনের রসিদ চান, তাকে জানানো হয়, তাদের মেশিনটি নষ্ট হয়ে আছে।

‘’আমার আশেপাশের যারা খেতে এসেছিলেন, তারা সবাই কিন্তু ওই হাতে লেখা কাগজের বিল দেখেই ওয়েটারের হাতে টাকা দিয়ে দিয়েছেন। সবাই ভ্যাট হিসাবে ১৫ শতাংশ টাকা দিলেও তার কোন কাগজ নেননি। আমাদের দেয়া টাকা আসলে সরকারের তহবিলে জমা হচ্ছে কিনা, বোঝার কোন উপায় নেই, ‘’ তিনি বলছেন।বাংলাদেশের সব ধরনের পণ্য এবং সেবার ক্ষেত্রে গ্রাহকরা বাধ্যতামূলকভাবেই মূসক দিয়ে থাকেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারে বেশিরভাগ ভ্যাট আসে মোবাইল ফোন, সিগারেট, কোমল পানীয়, গ্যাস ইত্যাদি খাত থেকে।

কর্মকর্তারা মনে করেন, অনেক খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করলেও তা ঠিকমতো সরকারি কোষাগারে যোগ হয় না।এই সমস্যা মেটাতেই পুরো ব্যবস্থাটিকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফের মতো সংস্থাগুলো।ক্রেতারা দোকান থেকে যে রসিদ নেবেন, সেটা এই মেশিন থেকেই বের হবে। সেই সঙ্গে এসব তথ্য এনবিআরের সার্ভারেও চলে যাবে।

ইএফডি মেশিনে, ভ্যাট ফাঁকি, বা ব্যবসায়ীদের হয়রানির তেমন সুযোগ নেই বলে কর্মকর্তারা বলছেন। কেননা এই যন্ত্রটি এনবিআর-এর সার্ভারের সাথে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত থাকায় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের বিক্রয়ের তথ্য সরাসরি এনবিআর-এর সার্ভারে চলে আসবে।ভোক্তারাও চাইলে মোবাইল অ্যাপে কিউআর কোডের মাধ্যমে এই ভ্যাটের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।

মঙ্গলবার অটোমেশনের যে প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, তাতে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় ইএফডি নামের একটি যন্ত্র স্থাপন, সংরক্ষণ ও তদারকি করবে।এতদিন ধরে যথাযথ ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যে সারাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিন ব্যবহার হতো। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত এই ইএফডি মূলত ইসিআর-এর উন্নত সংস্করণ।এর ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হবে, ফাঁকি রোধ হবে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও এনবিআরের জন্য ভ্যাটের হিসাব-নিকাশ রাখা সহজ হবে।

রেস্তোরা, মিষ্টান্নভাণ্ডার, আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, অভিজাত শপিং সেন্টারের সব প্রতিষ্ঠান, সুপার শপ, স্বর্ণ ও রূপার দোকান, আসবাবপত্রের দোকান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্র স্থাপন বাধ্যতামূলক।বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, দেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান ধাতে পরিণত হয়েছে এই ব্যবস্থা। দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এই খাত থেকে আসে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২০২৩) বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত থেকে মোট মূসক আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯২ শতাংশ।তবে এই খাত থেকে আরও বেশি মূসক আদায়ের সুযোগ রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব কর্মকর্তারা মনে করেন।আগামী চার বছরে মূসক খাত থেকেই ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা আদায় করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই বছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

মঙ্গলবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম সেদিন বলেছেন, এনবিআরের জনবল স্বল্পতায় কারণে সারা দেশে ইএফডির মাধ্যমের ভ্যাট সংগ্রহ সম্ভব নয়। এজন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাট সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন বেসরকারি এই সংস্থাটি আপাতত ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাজ শুরু করবে। সফলতা পাওয়া গেলে আস্তে আস্তে দেশের অন্যান্য স্থানেও এরকম প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হবে।

চ্যালেঞ্জ কাটাতে পারবে ইএফডি?

তিন দশক আগে মূসক ব্যবস্থা চালু করা হলেও এখনো ঠিকভাবে মূসক আদায় ও সরকারি কোষাগারে জমা পড়ার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে এই খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন,’’ প্রথম কথা হলো, এই অটোমেশন ঠিক মতো কার্যকর হবে কিনা? আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, সেই সময় ইসিআর বা ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার চালু করেছিলাম। সেটাই তো পুরোপুরি চালু করা যায়নি।''

এনবিআরের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি দেখেছেন, ব্যবসায়ীরা কাস্টমারদের রিসিট দিতো না, কেউ জোর করে চাইলে দিতো, যাদের ইসিআর মেশিন দেয়ার কথা,তারাও তো ঠিক মতো দেয়নি।‘’নতুন প্রযুক্তি আনলেন, শুনতে চমক লাগলো, কিন্তু সেটা কার্যকরী করার জন্য কতটা পদ্ধতি তারা নিশ্চিত করবে, তাদের দক্ষতা কতটা আছে, সেটাই হলো আসল ব্যাপার।

তিনি বলছেন, ‘’দ্বিতীয় হলো, চুরির মানসিকতা। যিনি দেবেন এবং যিনি তদারকি করবেন, তাদের মধ্যে যদি গোপন চুক্তি থাকে- যেটা অনেক সময় দেখা যায়- সেটা থাকলে তো এটা ফলপ্রুসু হবে না।‘’তিনি মনে করেন, এতে হয়তো এনবিআরের ইমেজ বাড়বে। কিন্তু তিনমাস বা ছয় মাস পরে যখন এটার ব্যয় তুলনা করা হবে, তখন আসলে বোঝা যাবে, এসব প্রযুক্তির পেছনে ব্যয় কতটা হচ্ছে, তারপরে এনবিআরের আয় কতটা বাড়ছে।

বাংলাদেশে ২০১২ সালে ভ্যাট আইন করা হয়েছিল, কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৭ সাল থেকে। ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার মুখে সেই আইনটির বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়।কারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করলেও প্যাকেজ পদ্ধতিতে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। তারা সেই অবস্থার পরিবর্তন চাননি।২০১৯ সালে আইনটির কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০২০ সাল থেকে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা অটোমেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যা অবশেষে এই বছর এসে আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিচ্ছে।

‘’দুই পক্ষের স্বচ্ছতা থাকলে আর আন্তরিকতা থাকলে, যেটুকু কারিগরি অভাব থাকে, সেটা আর কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই স্বচ্ছতা আর আন্তরিকতা কোন পক্ষেরই নেই,’’ বলছেন মি. রহমান।২০২১ সালে ভ্যাট গোয়েন্দারা ২০২১ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের আটটি মার্কেটে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল। সেখানে মোট ১০২৪টি দোকানের ওপর অনুসন্ধান করে দেয়া গেছে, এর মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা মাত্র ১২০টি। ভ্যাট দেয়না ৯০৪টি প্রতিষ্ঠান।

এমনকি বড় বড় শহরগুলোয় অসংখ্য খাবার, কাপড় বা সেবা প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের তালিকাভুক্ত নয়। দেশের মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশটিকেই পুরোপুরি ভ্যাটের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোয় এই ভ্যাট না দেয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। যদিও ভ্যাট আইন অনুযায়ী যে কোন ভ্যাটযোগ্য ব্যবসা শুরু করার পূর্বেই নিবন্ধন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।এনবিআরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, পর্যায়ক্রমে ইএফডি মেশিন স্থাপন করা হলে ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে। আর বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ায় লোকবল ও নজরদারির অভাবও থাকবে না।

কিন্তু অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভ্যাট আদায়ে এনবিআরের দক্ষতা, লোকবলের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি তাদের সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে।বিভিন্ন সময় ভ্যাট আইনের সাথে সংযুক্ত ছিলেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।তিনি বলছেন, ‘’সত্যিকার অর্থে এনবিআরের যথেষ্ট সদিচ্ছা নেই। অনেক কথা বলা হয়, কিন্তু আসল কাজ হচ্ছে না। তারাও পেপারবেইজড সিস্টেম থেকে পুরোপুরি বের হতে পারছে না। এখনকার সিস্টেমে তারা খুব কমফোর্টেবল।''

''তারা পারছে না, তা নয়, তারা আসলে পারতে চায় না। এর কারণ দুর্নীতি, বর্তমান সিস্টেমে তারা টাকা আয় করতে পারে, তাই তারা এর পরিবর্তন চায় না। ব্যবসায়ীরাও এটার সাথে সংযুক্ত, উভয় পক্ষের মধ্যে আসলে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক আছে,‘’তিনি বলছেন।এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কেউ কথা বলতে চাননি।তবে মঙ্গলবার ইএফডির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, এই যন্ত্র দেশে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা তৈরি করবে। এক্ষেত্রে জনসাধারণকেও সচেতন হওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।

সূত্র : বিবিসি