যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী দল ঢাকায় কী করছে, তাদের কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ কেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী দল ঢাকায় কী করছে, তাদের কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ কেন

বাংলাদেশে কয়েক মাসের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই আর এনডিআই- এর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বুধবার ঢাকায় সচিবালয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মার্কিন দল তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে যে- সরকার ঠিক মতো নির্বাচন করতে পারবে কিনা ও সেই সক্ষমতা আছে কিনা। আর বিরোধী দল নির্বাচনে আসলে ঠিকমতো প্রচারের সুযোগ পাবে কিনা।

“তারা জানতে চেয়েছে প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীন বোধ করলে কিংবা কোন দল যদি মনে করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে তখন সরকার কি করবে? জবাবে আমরা বলেছি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা আগে হতো, এখন আর এগুলো হয়না। আর আমাদের বাহিনীগুলো সুন্দর নির্বাচনের জন্য তৈরি হয়ে আছে। তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে তারা,” সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে বলছিলেন তিনি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্ব-পরিস্থিতি যাচাই করতে মার্কিন এই দলটি ঢাকায় এসেছে গত ৭ই অক্টোবর এবং সাত সদস্যের এ দলটির আগামী ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করার কর্মসূচি রয়েছে।

নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য ঢাকায় আসা আইআরআই ও এনডিআইয়ের- এ যৌথ দলটির যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকায় এসেছে। এ দলটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই সংসদ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন সংক্রান্ত অন্যান্য সিদ্ধান্তও নেয়া হবে এই দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।ঢাকায় এসে দলটি ইতোমধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, নির্বাচন কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ- এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন 'এনডোর্স' করবে কিনা সেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটিই নির্ভর করবে ঢাকা সফররত দলটির প্রতিবেদনের ওপর।

মি. কলিমউল্লাহ পূর্ব তিমুর, হংকং, মিশর, নাইজেরিয়ায় আইআরআই ও এনডিআইয়ের সাথে একই ধরণের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ দলে কাজ করেছেন।আরেকজন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলিম বলছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এ দলটি সরকারের অর্থায়নেই এ দেশে আসছে এবং এ থেকেই বোঝা যায় তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশই মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে কী উঠে এসেছে

মার্কিন এই মিশনটির সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন নির্বাচন নিয়ে বিরোধী বিএনপি যে দাবি করছে সেটিকে তারা সংবিধান সম্মত মনে করেন না।

মার্কিন দলটি নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোষের কোন উপায় আছে কিনা জানতে চেয়েছিলো জানিয়ে মি. কাদের বলেছেন সমঝোতার পথ বিএনপিই বন্ধ করে দিয়েছে। আর সংবিধান লঙ্ঘন করে কোন সমঝোতায় আওয়ামী লীগ আগ্রহী নয়।

তবে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল সূত্রে জানা গেছে যে বৈঠকে মার্কিন দলটি নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রায় প্রতিটি বিষয় এবং বিরোধী দলের দাবিগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে চেয়েছে।অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে দলটির নেতারা মার্কিন দলটিকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোন সুযোগই নেই বলে মনে করেন তারা।

বৈঠকের পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন তারা নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন।এছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধাগুলো কী কী হতে পারে – এমন প্রশ্নও মার্কিন দলটি জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে করেছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ ও তফসিলের সময়সীমাসহ পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেই জানতে চেয়েছিলো মার্কিন দলটি।পরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও নির্বাচনী বিধিবিধান সম্পর্কে মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটিকে বিস্তারিত জানিয়েছেন তারা।

“ওরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং কার্যক্রমসহ অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমরা সবকিছু তাদের সামনে তুলে ধরেছি। তারা যা যা জানতে চেয়েছিল, আমরা জানিয়েছি। এখন তারা কী করবে, তা আমরা জানি না। হয়তো তারা দেশে ফিরে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে- নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কী পাঠাবে না। অথবা পাঠালে কীভাবে পাঠাবে,” সিইসি বলছিলেন।এর বাইরে সিভিল সোসাইটি, নারী প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার সময় মূলত নির্বাচনে সহিংসতার সম্ভাবনা কতটা, সবার জন্য সঠিক পরিবেশ আছে কি-না মূলত এগুলোই ছিলো মার্কিন দলটির মূল জিজ্ঞাসা।

কেন এই দলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ

নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন ঢাকা সফররত মার্কিন এই দলটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকায় এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ফান্ড (জনগণের করের টাকা) ব্যয় করে কোন টিমকে নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানোর মানেই হলো এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সে দেশের সরকার।বিশেষ করে ৯০ এর দশকে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে এ ধরণের টিমগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা দিয়েছিলো।

এখন ঢাকা সফররত দলটি মূলত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ যে অচলাবস্থা তার কারণ ও গভীরতা কতটা।এছাড়া রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী বা কমিউনিটির কথা শোনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কী ধরণের ভূমিকা পালন করা উচিত বলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা মনে করে সেটিও তারা বোঝার চেষ্টা করছে।

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ নিজেও এ দলটির সঙ্গে একটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কতখানি আছে সেটাই তারা এসেস করার চেষ্টা করছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই তারা বাংলাদেশর নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। শেষ দুটি নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করেনি। এবার করবে কিনা বা মার্কিন সরকার নির্বাচনকে এনডোর্স করবে কিনা- সেটি নির্ভর করবে এ টিমের সুপারিশের ভিত্তিতেই”।এর বাইরেও বিশ্লেষকরা যেসব মার্কিন এ দলটির ঢাকা সফরকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাদের মতে গত প্রায় দু বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র নিয়ে দুট সম্মেলনের আয়োজন করেছে কিন্তু বাংলাদেশকে তাতে আমন্ত্রণ করা হয়নি। পাশাপাশি র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরুতে ভিসা নীতি ঘোষণার পর সম্প্রতি সে নীতি প্রয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন।ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের ভিসা নীতি ‘বিশেষ কোন পেশা ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নয়’—সবার জন্য প্রযোজ্য। যারাই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে তার যে কারও ওপর আরোপ করা হতে পারে’।

এর বাইরে ঢাকায় ইউরোপীয় কূটনীতিকদের সাথে নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পরিষ্কার করে বলেছেন যে তারা বাংলাদেশে অবাধ নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়।“সবকিছু মিলে বাংলাদেশের প্রাক নির্বাচনী পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপযোগী কিনা সেটাই উঠে আসবে তাদের প্রতিবেদনে। তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে যে যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে কিনা। সেই সঙ্গেই সিদ্ধান্ত হবে তারা পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে তাদের করদাতাদের মূল্যবান অর্থ ব্যয় করবে কিনা,” বলছিলেন মি. কলিমউল্লাহ।

বিশ্লেষক আব্দুল আলিম বলছেন যে কোন নির্বাচনের আগে প্রি-ইলেকশন এসেসমেন্ট যারা করে, তারা মূলত দেখে বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, সবার জন্য নির্বাচনী মাঠ সমান কি-না, নির্বাচনের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা নিরপেক্ষ ও নির্বাচনের প্রচারণাকাল ও নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি কেমন হতে পারে।“এ ধরনের সেট কোশ্চেন থাকে সাধারণত—সেটা ধরেই তারা মতামত গ্রহণ করে। আলোচনাতেও কিছু সম্পূরক প্রশ্ন আসতে পারে। ঢাকায় যারা এসেছে তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থে এসেছে। এটা পরিষ্কার যে তাদের রিপোর্ট আর সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে যুক্তরাষ্ট্র,'' তিনি বলেন।

সূত্র : বিবিসি