শিক্ষাব্যবস্থা : অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হচ্ছে আমাদের?

শিক্ষাব্যবস্থা : অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হচ্ছে আমাদের?

এমদাদুল হক সরকার

শিক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ হচ্ছে " লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।" উক্ত প্রবাদটির মতোই ইংরেজিতে আরেকটি প্রবাদ আছে "নলেজ ইজ পাওয়ার বা জ্ঞানই শক্তি।" কোন শিশু যখন পড়ালেখা করতে চায়না অথবা শিক্ষার উদ্দেশ্য সমন্ধে জানতে চায় তখন তার পিতা মাতা ও শিক্ষকরা উক্ত প্রবাদ দুটি বলে তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের শিশুরাও সরল মনে অবিভাবক ও শিক্ষকদের বলা সেই প্রবাদ দুটি মেনে চলে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা যাক। প্রথম প্রবাদটি দ্বারা বুঝায় পড়ালেখা করলে গাড়ি ঘোড়া চড়া যাবে অর্থাৎ বাহ্যিক ধনধৌলত ও সমৃদ্ধি অর্জন করা যাবে।

আর দ্বিতীয় প্রবাদটি দ্বারা জ্ঞানকে প্রকৃত শক্তি হিসেবে বলা হলেও আমরা বুঝি গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার মতো বিষয়কেই। অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করলে উচ্চ পদে আসীন হওয়া যাবে। ফলশ্রুতিতে অঢেল সম্পদ ও "পাওয়ার" (ক্ষমতা) অর্জন করা যাবে। অতএব আমরা কি বলতে পারি শিক্ষাকে বিনিয়োগ হিসেবে কল্পনা করছে আমাদের সমাজ? যে যত বেশি বিনিয়োগ করবে সে তত উচ্চ ক্ষমতার অধিকারি হবে। তাহলে কি বলা চলে আমাদেরকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হচ্ছে ভবিষ্যতে অঢেল সম্পদের লিপ্সা দেখিয়ে? এবার আসুন নজর দেয়া যাক বাস্তবতার দিকে। এসএসসি ও এইচ এসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরের চিত্রের দিকে তাকালেই বুঝা যাবে বাল্যকালে শোনা সেই প্রবাদকে কতটা মনে প্রানে ধারন করেছে আমাদের সমাজ। আজকাল যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা দেখলেই বোঝা যায় জিপিএ-৫ না পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। হালের নতুন সংযোজন গোল্ডেন জিপিএ পেতে হবে! পেলে তো ভালোই। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এসএসসি রেজাল্ট প্রকাশের পরদিনই জানা গেলো বেশ ক জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর জন্য দায়ী করা? অবিভাবক, আমাদের সমাজ ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নয় কি? কারন তারাই বাল্যকালের মতো কৌশোরে আমাদের শিখাচ্ছে ভালো ফল না করলে ভালো কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবেনা। ফলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার অবস্থা আরো বাজে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে যান জ্ঞান চর্চার জন্য নয়, চাকুরির প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। সেখানকার শিক্ষাগুরুরা বাল্যকালে শোনা সেই প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন। তারা ব্যস্ত আছেন প্রবাদের সেই ক্ষমতা ও রাজনীতি নিয়ে। লাল,নীল,কমলা,বেগুণী হরেক রঙের দল নিয়ে ব্যস্ত তারা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কারোর মধ্যেই গবেষণা করার পর্যাপ্ত সুযোগ ও স্পৃহা নেই। পর্যাপ্ত গবেষণাপত্র বের হচ্ছেনা।

ফলে দায়সারা ভাবে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো। এদিকে একাডেমিক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে মিল নেই চাকরির বাজারের পড়াশোনার। ফলে জ্ঞান অর্জন ও গবেষনা বাদ দিয়ে গাদা গাদা বই মুখস্তের মিশনে আছেন চাকরি প্রত্যাশীরা। আমাদের হর্তা কর্তারা কদিন পর পর বিদেশ ভ্রমন করে শিক্ষায় নতুন নতুন নিয়ম সংযোজন করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কোনোটাই হচ্ছেনা। ফলে দিন দিন বাড়ছে জিপিএ-৫ ও বেকারত্বের দৌরাত্ম্য। রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা নিজের ক্ষেতে ফসল খারাপ তাই অন্যের ক্ষেত থেকে ধার করে ফসল এনে সুফলন দেখানোর মতো। শিক্ষার হার বাড়ছে এটা মানতে হবে। কিন্তু মানের ক্ষেত্রে আপস হলে সেটা কোনো ভালো ফল দেবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবমুখী শিক্ষা ও মূল্যায়ন যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন একে পদ্ধতিগত জটিলতামুক্ত রাখা, যেখানে শুধু পদ্ধতিটা মুখ্য না হয়ে শিক্ষাটাই হবে মূল বিষয়। এ ক্ষেত্রে জিপিএ-৫ কিংবা গাদা গাদা চাকরির বই মুখস্তের দৌড়ে পা না রেখে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিটারও সংস্কার আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।

 এমদাদুল হক সরকার:শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: amdadulh008@gmail.com