ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : বছরজুড়ে আলোচনায় র‌্যাগিং-মারামারি, বহিষ্কার ১১

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : বছরজুড়ে আলোচনায় র‌্যাগিং-মারামারি, বহিষ্কার ১১

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : বছরজুড়ে আলোচনায় র‌্যাগিং-মারামারি, বহিষ্কার ১১

ঘটনাবহুল ২০২৩ বিদায় নিচ্ছে আজ। শুরু হচ্ছে নতুন বর্ষ। গেল বর্ষজুড়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানা ঘটনায় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। কিছু ঘটনায় আলোচনা গড়িয়েছে ক্যাম্পাস ছাপিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। নেতিবাচক ঘটনার মধ্যে র‌্যাগিং ও মারামারির ডজন খানেক ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এসব ঘটনায় পাঁচজনকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ১১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে নবীন ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতে ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ফুলপরী খাতুন নামের নবীন ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন ও আপত্তিকর ভিডিও ধারণের অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়, হল ও ছাত্রলীগ পৃথকভাবে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।এছাড়া বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট হলে হাইকোর্টের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন। পরে ৪ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় অন্তরাসহ পাঁচ ছাত্রীকে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি তাদের সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২১ আগস্ট ২৬০তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় জড়িত পাঁচ ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

র‌্যাগিংয়ের এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে রিট চলাকালেই ১৯ জুন লালন শাহ হলে ফের নবীন এক ছাত্রকে রাতভর দফায় দফায় নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রকে নগ্ন করে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ করলেও পরে ছাত্রলীগ নেতারা তার সঙ্গে কথা বলার পর ফের লিখিত আবেদন দিয়ে অভিযোগ তুলে নেয়। র‌্যাগিং প্রতিরোধ সেল থেকে এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও পরে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে ক্যাম্পাসে র‌্যাগিং বিরোধী প্রচারণা চলা কালেই গত সেপ্টেম্বরে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক নবীন ছাত্রকে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা রেজিস্ট্রার বরাবর মেইলে প্রথমে অভিযোগ করেন। পরে প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ করে ভুক্তভোগী ছাত্র। অভিযোগে ম্যানার শেখানোর নামে র‌্যাগিং ও গালিগালাজসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হলে প্রতিবেদনের আলোকে বিভাগীয় সিনিয়র পাঁচজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় আলোচনার মাঝেই বছরজুড়ে মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনায় বারংবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। ১৪ মার্চ হল প্রশাসন আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের তথ্য নিতে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের রুমগুলো পরিদর্শনে গেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা হট্টগোল শুরু করে ও বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় হল কার্যালয়ে ভাঙচুর ও হল প্রভোস্ট আব্দুল জলিল পাঠানকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠে।

১৬ মার্চ ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা মিলে ক্যাম্পাসে ব্যাচ ভিত্তিক অনুষ্ঠান অবতরণিকা উৎসবের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের দিন টি-শার্ট বিতরণ নিয়ে বাকবিতন্ডার জেরে মারামারিতে জড়িয়ে পরে তারা। এতে ৩ শিক্ষার্থী আহত হয়। একই ঘটনার জের ধরে ফের ৬ মে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে দুই পক্ষ কয়েক দফায় লিখিত অভিযোগ জমা দেয়।

২৬ এপ্রিল বন্ধ ক্যাম্পাসে বাইক নিয়ে ঢুকতে নিষেধ করায় প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ নিরাপত্তাকর্মীদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠে দুই ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত তরিকুল ইসলাম তরুণ ও সামিউল ইসলাম শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

১৪ মে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি এ টি এম এমদাদুল হককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠে। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার একটি উপ-কমিটিতে সম্পাদকের বাবাব নাম না রাখার জেরে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

১০ জুলাই রাতে অ্যাম্বুলেন্স দিতে দেরি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে ভাংচুরের অভিযোগ উঠে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রেজওয়ান সিদ্দিকী কাব্যসহ দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে। মাদকাসক্ত অবস্থায় এমনটি করেছে বলে দাবি মেডিকেল কর্তৃপক্ষের। এসময় চিকিৎসকের সঙ্গেও অসদাচরণের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় চিকিৎসাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে তদন্ত সাপেক্ষে কাব্যকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। জড়িত অন্য দুইজনকে সতর্ক করা হয়।

২০ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ। সভা শেষে কথা কাটাকাটির জের ধরে মিলনায়তনের সামনে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। এতে পাঁচজন আহত হন। পরে ২২ আগস্ট সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত আট ছাত্রলীগকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি এটি এম এমদাদুল আলমকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। কর্মকর্তা সমিতির কর্মবিরতিকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তাদের এক পক্ষের হয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটান বলে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।

২১ নভেম্বর একই মাঠে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের দু’গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। ফুটবল খেলার মাঝে ক্রিকেট বল প্রবেশ করলে ঘটনার সূত্রপাত। দুই পক্ষই বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপনের জন্য রাখা বাঁশসহ লাঠিসোঁঠা নিয়ে মারামারিতে জড়ায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মারামারির ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় পরবর্তীতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাৎ হোসেন আজাদ বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের আলোকে কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ক্যাম্পাসে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে।