২০২৩ সালের যত বিতর্কে আলোচনায় কুবি

২০২৩ সালের যত বিতর্কে আলোচনায় কুবি

২০২৩ সালের যত বিতর্কে আলোচনায় কুবি

শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০২৪। ২০২৩ বছরজুড়ে উপাচার্যের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তে আলোচনায় ছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা, প্রশাসনিক অনিয়ম, নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক বহিষ্কার, ক্যাম্পাসে সংবাদপত্র প্রবেশে বাধা ও দুর্নীতি বিষয়ে উপাচার্যের বিতর্কিত বক্তব্যসহ নানা কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সেসব ঘটনা নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সালতামামি-২০২৩।

পদে পদে অনিয়ম করে শিক্ষক নিয়োগ:

পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নানা অনিয়ম ও আপত্তির পরও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) মার্কেটিং বিভাগে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রার্থী আবু ওবায়দা রাহিদকে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম. আবদুল মঈন। তাঁকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তিতে ‘অননুমোদিত’ বাড়তি অনুবিধি যোগ, অধিক যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া, উত্তরপত্রেও শনাক্ত চিহ্ন রাখা, প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশ না করলেও রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে নিজেরাই সুপারিশ করাসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়েই তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। এভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ না দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আইনি নোটিশ পাঠালেও উপাচার্য দায়সারা জবাব দিয়েই নিয়োগ দিয়েছেন তাঁকে।

সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের আসামিকে নিয়োগ:

নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার আসামি রেজাউল ইসলাম মাজেদকে নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসন। গত ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় তার নিয়োগ চূড়ান্তকরণ করা হয়। নিয়োগে যথাযথা নিয়ম না মানায় সিন্ডিকেট সভায় নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) আসলেও সেসবের তোয়ক্কা করেননি উপাচার্য।

প্রক্টরকে একচেটিয়া প্রশ্রয়:

গত ৬ মার্চ কুবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পরদিনই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। পরদিনই বহিষ্কৃত দুই নেতাসহ আরও একজনকে বেধড়ক মারধর করা হয় ক্যাম্পাস ফটকেই। এ ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে আন্দোলন থামিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন তারা। 

এ ঘটনায় প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীর ইন্ধনের দাবি করে প্রক্টর অপসারণ ও মারধরকারীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, কনসার্ট ফর জাস্টিস ও আমরণ অনশন করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে আন্দোলনের মুখে দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হলেও প্রক্টরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

বরং ব্যবস্থা গ্রহণের বিপরীতে পুরষ্কার হিসেবে বছরের শেষদিকে এসে সেই প্রক্টরেরই পিএইচডি নিয়মবহির্ভূতভাবে নথিভূক্ত করেছেন উপাচার্য। ডিগ্রি যাচাই-বাছাই কমিটি পিএইচডি গ্রহণের সুপারিশ না করলেও উপাচার্য নিজ ক্ষমতাবলে তা নথিভুক্ত করান। বিষয়টি ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া নয় বলে উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে দাবি করছেন অন্যান্য শিক্ষকরা। 

আইন না মেনে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ:

আইন না মেনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) চার বিভাগে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান) বিভাগীয় প্রধানকে পুনর্বহালের অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-২০০৬ এর ২৪ (২) ধারা ও ২৪ (৩) ধারায় বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে অধ্যাপকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে তিন বছর মেয়াদে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে উপাচার্যের। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগে যদি অধ্যাপক না থাকেন তবে সহযোগী অধ্যাপকের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত চারটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন না মানার অভিযোগ রয়েছে। বিভাগীয় প্রধানের পদ ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিটও করেছেন এক অধ্যাপক। রিটে সে অধ্যাপককে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ দিতে আদালত থেকে বলা হলেও এখনো সে আদেশ মানেননি কুবি উপাচার্য।

দুর্নীতির পক্ষে উপাচার্যের সাফাই বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিক বহিষ্কার:

‘দুর্নীত হচ্ছে বলেই দেশে উন্নতি হচ্ছে’। গত ৩১ জুলাই মার্কেটিং বিভাগের নবীনবরণ ও প্রবীনবিদায় অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। উপাচার্য বিষয়টিকে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বলে দাবি করলেও তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা করেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। উপাচার্যের এ বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রকাশ করায় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সাংবাদিক রুদ্র ইকবালকে বহিষ্কার করেবিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার জড় তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা। পরে হাইকোর্টে রিট করে ১৪ আগস্ট ছাত্রত্ব ফিরে পান রুদ্র ইকবাল।

গণমাধ্যম প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা:

সংবাদ প্রকাশের জেরে রুদ্র ইকবালকে বহিষ্কারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় একটি গণমাধ্যম প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত হকার ইউসুফ মিয়া পত্রিকা বিলি করতে আসলে তাকে স্থানীয় ‘দৈনিক আমাদের কুমিল্লা’ কুবিতে না দেওয়ার নির্দেশনা দেন ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক। বিষয়টি সম্পর্কে এমদাদুল হককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, উপাচার্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা রাখতে নিষেধ করেছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও ঢুকতে পারবে না আমাদের কুমিল্লা।

তবে কী কারণে এমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, আমি কিছু জানি না। উপাচার্য স্যার নিষেধ করেছেন।

উপাচার্যের গাড়ি বিলাস:

৬ বছর ব্যবহার করা গাড়ি থাকলেও নতুন করে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় গাড়ি ক্রয় করেন উপাচার্য আবদুল মঈন। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বরাদ্দ থেকে কুবি উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের জন্য নতুন গাড়ি ক্রয়ে ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় ইউজিসি। তবে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে একইসাথে দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন উপাচার্য। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিয়োগের সোয়া দুই বছর পার হলেও তাঁর জন্য এখনও কোনো গাড়ি ক্রয় করা হয়নি। 

উপাচার্যের কুক্ষিগত ঢাকার গেস্ট হাউস:

উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের জন্য ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজধানীর কমলাপুরে একটি গেস্ট হাউজ ক্রয় করা হয়। সেখানে উপাচার্যের জন্য নির্ধারিত আলাদা একটি কক্ষ থাকলেও পুরো বাসাটিই একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন। তিনি ব্যতীত কেউই যেতে পারেন না সেখানে। এমনকি গেস্ট হাউজের চাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট দপ্তরে থাকার নিয়ম থাকলেও সেটি নিজের দখলে রেখেছেন উপাচার্য।

ডিন হিসেবে ইউজিসি সদস্য হলেন কুবি উপাচার্য:

গত ১৮ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন আইন অনুষদের নতুন ডিনের দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী এবং এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশও জারি করা হয়। যদিও বিষয়টিকে উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে দাবি করেছেন শিক্ষকরা। উপাচার্য হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) খণ্ডকালীন সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকার পরও পরবর্তীতে ডিন হিসেবেই এ সুযোগ নিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। বিষয়টিকে উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার দাবি করে তাঁর সমালোচনা করেন শিক্ষকরা।

শর্তপূরণ ছাড়াই উপাচার্যের নির্দেশে অধ্যাপক পদোন্নতি:

প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও শর্তপ‚রণ না করেই অধ্যাপক হয়ে গেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোসা. শামসুন্নাহার। গত ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় তার পদোন্নতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদিও শর্ত পূরণ না হওয়ায় তাঁর পদোন্নতিতে বোর্ডের এক সদস্য আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানিয়েছেন। তবুও উপাচার্য নিজের ইচ্ছেমতো তাঁকে পদোন্নতি দেন।

এদিকে বছরের শেষ সপ্তাহে গত ২৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মো. আবু বক্কর সিদ্দীককে থাপ্পড় মেরে আলোচনায় আসেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আলী মোর্শেদ কাজেম। আইন বিভাগের  ১২১ তম একাডেমিক সভায় কোর্স ভাগাভাগি নিয়ে বিতর্ক জড়িয়ে পড়লে এই ঘটনা ঘটে। বিষয়টি দেশব্যাপী সমালোচনার জন্ম দেয়। বিষয়টি নিয়ে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের স্থায়ী অপসারণ চেয়ে বছরের শেষদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন এবং উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। 

এছাড়াও উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের ছুটি না দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অংশীজনদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়াসহ নানাবিধ কারণে সংবাদের শিরোনাম ছিলেন উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এর বাইরে গবেষণায় উন্নতি, ভর্তিপরীক্ষার টাকা থেকে ভাইস চ্যান্সেলর স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড প্রদানসহ কিছু ইতিবাচক কাজও আলোচনায় আসে ২০২৩ জুড়ে।