ভারতে ট্রেন দূর্ঘটনায় কোন মুসলিম বাড়িতে রান্না হয়নি

ভারতে ট্রেন দূর্ঘটনায় কোন মুসলিম বাড়িতে রান্না হয়নি

ছবিঃ সংগৃহীত।

একদিকে ঈদের নামাজ শেষে কোরবানির প্রস্তুতি অন্যদিকে তখনি ঘটলো ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে সেটি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। ট্রেন দুর্ঘটনার পর দেখা যায় মুসলিমরা দলে দলে ট্রেন দুর্ঘটনায় দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। কোনো বাড়ীতে রান্না হয়নি। এমনকি কোরবানি দেয়া হয়নি।

জানা যায়, প্রথমে বিকট শব্দ। তারপরে ট্রেন লাইনে নজর পড়তেই চমকে উঠেছিলেন সবাই। সোমবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফাঁসিদেওয়ার রাঙাপানির কাছে, জালাস গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট নির্মল জোতের বাসিন্দাদের অনেকেরই দিন শুরু হয় আঁতকে ওঠা দিয়ে।

এদিন সকাল পৌনে ৯টার দিকে কানফাটানো আওয়াজের পরে সেখানের বাসিন্দারা দেখেন যে মালগাড়ির ইঞ্জিনের ওপরে উঠে গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি কামরা। ধাক্কায় প্রায় গুঁড়িয়ে গেছে অপর একটি। যাত্রীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল গ্রাম-জুড়ে।

প্রথমে স্থানীয়েরাই উদ্ধার কাজ শুরু করেন। গ্রামবাসীরা বাড়ি থেকে পানি, চাদর নিয়ে আসেন। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটি কামরার ভেতর থেকে যাত্রীদের বের করে আনা হয়।রেলওয়েতে খবর যাওয়ার পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায় এনডিআরএফ কর্মীদের।

ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়েই আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও আসতে শুরু করেন। হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো শুরু হয়।গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিবুল, মোহাম্মদ রাহুলেরা বলেন, ‘মানুষের আর্তনাদ শুনে, শরীরের অংশবিশেষ রেললাইনে পড়ে থাকতে দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। চুপ করে বসে থাকতে পারিনি।’

এলাকার মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ বসির উদ্দিন বলেন, ‘কোনো বাড়িতে রান্না হয়নি। সোমবার কোরবানির ঈদ ছিল। কোনো বাড়িতে কোরবানি হয়নি। যুবক, নারী সকলেই দুর্ঘটনাগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। জখম যাত্রীদের কোলে নিয়ে মেডিক্যালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন গ্রামবাসীরা। পরে উদ্ধারকারী দল পৌঁছায়।’

৫০টিরও বেশি অ্যাম্বুল্যান্স দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আহতদের অ্যাম্বুল্যান্সে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ দিন সকালের পরে দুর্ঘটনাস্থল থেকে একের পরে এক অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকছে। তা থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মীরা বের করে আনছেন কখনো মাথা থেঁতলে যাওয়া, হাত, পা কাটা, রক্তাক্ত শরীর। রাস্তা-জুড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ট্রলি থেকে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পরিচিতেরা নিখোঁজ রেলযাত্রীদের খোঁজ করতে এসেছেন।

হাসপাতালের এক নার্সের মোবাইলে একজন ছবি পাঠিয়েছেন। তিনি রেলের কর্মী। তার আত্মীয় কান্দি মহকুমা হাসপাতালে কাজ করেন। সেই সূত্রে পরিচিতদের মাধ্যমে হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছিলেন রেল দুর্ঘটনায় জখমদের মধ্যে রয়েছেন কিনা। ওই ছবির সাথে ডেপুটি সুপারের কাছে থাকা নিহতদের একজনের ছবির মিল পেতেই বুকটা কেঁপে ওঠে সকলের। পরিবারকে হাসপাতালে আসতে বলা হয়। নিহত ওই ব্যক্তি রেলকর্মী শঙ্করমোহন দাস।

জরুরি বিভাগে শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন আর মেয়ের কথা ভেবে কাঁদছেন ছবি মণ্ডল। তারও চোট লেগেছে। তিনি বলেন, ‘মেয়ে ভালো নেই। ওর রক্ত লাগবে। ওর কী হলো?’ তার ছয় বছরের মেয়ে স্নেহা গুরুতর আহত। তার অস্ত্রোপচার হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় ছিলেন।

আর এক যাত্রী শান্তনু ভুঁইয়ার ডান পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ এবং কেঁপে উঠল ট্রেনটা। ছিটকে পড়ি। পায়ে চোট লাগে। খুব জোর রক্ষা পেয়েছি।’

এক-এক সময় শোনা যাচ্ছিল স্বজনহারানো বাড়ির লোকের হাহাকার। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশিস দে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তার এ দিন ‘ডিউটি’ ছিল শতাব্দী এক্সপ্রেসে। কোনো কারণে তিনি তা বদলে কাঞ্জনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে নিয়েছিলেন। তার পরিবার শিলিগুড়ি শহরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বলাকার বাসিন্দা। তার স্ত্রী এবং মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

আত্মীয় পঙ্কজ দে বলেন, ‘সরকারের উচিত সিগন্যালগুলোকে ঠিক করা। না হলে এমন অনেক দুর্ঘটনা হবে।’বিকেল ৪টার দিকে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে বলেন, ‘কারণ খোঁজা হচ্ছে। তবে যে কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে, সে কারণে আগামীতে যাতে আর দুর্ঘটনা না ঘটে তা দেখা হবে।’