সিন্ডিকেট ভেঙে স্বর্ণের দাম কমানো সম্ভব?

সিন্ডিকেট ভেঙে স্বর্ণের দাম কমানো সম্ভব?

ছবি: সংগৃহীত

দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। সিআইডি ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ ও হীরা আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, স্বর্ণের বাজারে সিন্ডিকেট ভেঙে দাম কমানো সম্ভব কি না। দেশে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি হয় না, ফলে ‘সিন্ডিকেট’ দ্বারা স্বর্ণের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ পুরনো। চোরাচালানের মাধ্যমে যে স্বর্ণ আসে, তা দেশের বাজারে বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করেন। দাম নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে থাকেন।

সরকার স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে না, বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশন (বাজুস) করে। ব্যবসায়ীরা বলেন, বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা ত্রুটিপূর্ণ। ফলে স্বর্ণ আমদানি হয় না। বিশেষজ্ঞরা জানান, এই খাতে জবাবদিহিতা ও নজরদারি নেই, বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে এবং মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্যও দেখা হয় না।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা এবং সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় দাম নির্ধারণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অংশগ্রহণ জরুরি। এছাড়া বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি সহজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সরকার ২০১৮ সালে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা প্রণয়ন করে, যা ২০২১ সালে সংশোধিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বছর ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দিয়েছিল। শুরুতে কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি করলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা বলেন, নীতিমালার ত্রুটির কারণে স্বর্ণ আমদানি সম্ভব হয়নি। স্বর্ণের আমদানির জন্য পারমিশন থেকে শুরু করে সম্পন্ন হতে ২৪-২৫ দিন লাগে এবং নানা জটিলতার কারণে তা এগোয় না। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সরকারের আমদানি নীতিমালা ও ব্যাগেজ রুলসের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।

সিন্ডিকেটের প্রভাব ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীর তাঁতীবাজারে বুলিয়ান মার্কেটের দাম অনুসরণ করে বাজুস স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে। বুলিয়ান মার্কেটের সিন্ডিকেটের কারণে স্বর্ণের দাম উচ্চ রাখা হয়। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, চোরাচালান-কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পার্থক্য বাংলাদেশে বুধবার ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এক লাখ ২৬ হাজার ৩২১ টাকা। অপরদিকে, ভারতের কলকাতায় একই দিনে ২২ ক্যারেট এক ভরি স্বর্ণের দাম বাংলাদেশি টাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৬৫৩ টাকা। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে পার্থক্য ১৫ হাজার ৬৬৮ টাকা।

চোরাচালান রোধের পরামর্শ বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের চোরাচালানের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালাকে আইনি কাঠামোয় আনতে হবে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সমন্বিত নজরদারি প্রয়োজন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অংশগ্রহণ জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করতে হবে এবং সেই বিষয়টিকে উৎসাহিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সার্বিক পরিস্থিতি স্বর্ণের বাজারে স্বচ্ছতা আনতে এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।