সমাজের দুর্নীতি রোধে ইসলামী আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

সমাজের দুর্নীতি রোধে ইসলামী আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

প্রতীকী ছবি।

ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। কল্যাণকামী জীবনব্যবস্থা। যেখানে নীতিবহির্ভূত কোনো কাজ যেমন: অনিয়ম, সুদ-ঘুষ, অবৈধভাবে অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাত, অন্যায়-অপকর্ম, জুলুম-অত্যাচার ও দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি বরদাস্ত করা হয় না। কেননা তা মারাত্মক অপরাধ। ইসলামে সব রকম নীতিবিরুদ্ধ কাজকেই দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যায়-অনিয়মকে কোন রকমের প্রশ্রয় দেয়া হয়না। ইসলামে অসদুপায় অবলম্বনের কোনো স্থান নেই। এখানে দুর্নীতি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পদ্ধতিতে ভক্ষণ কর না এবং শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ কর না; যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলে ইসলামি আইন ও শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ইসলামি আইন হচ্ছে একমাত্র আইন যা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম। এ আইনের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাতি, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বকালে সব সমাজে এ আইন প্রয়োগযোগ্য। প্রকৃতির দিক থেকে গতিশীল এবং ইজতিহাদের সুযোগ থাকায় ইসলামি আইন সময় ও স্থানের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যায়। বর্তমান আধুনিক যুগেও ইসলামি আইনের বিকল্প অন্য এমন কোন আইন নেই যা মানুষের জীবনে সর্বজনীন কল্যাণ সাধন করতে পারে। কেয়ামত পর্যন্তও হবে না । সৃষ্টির আদিকাল থেকে দুর্নীতি বন্ধের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কোন কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি।

ইসলামি আইনের মূল ভিত্তি হচ্ছেন মহান আল্লাহ তাআলা। এ জন্য মানুষকে আল্লাহমুখী করা । আখেরাতের শাস্তির ভয় দেখানো । জনসাধারণকে বুঝানো- দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা যায় কিন্তু শান্তি অর্জন করা যায় না। অপরাধ আর অশান্তি একটা আরেকটার সাথে উতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা ন্যায়নীতি মেনে চলে তাদের অন্তরে শান্তি বিরাজমান থাকে। দুনিয়াতে অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক আখিরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। তখন অন্যায়ভাবে উপার্জিত সম্পদ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। তবে যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করেছেন, অপরাধ ছেড়ে দিয়ে সৎভাবে জীবন যাপন করেছেন তারা আল্লাহর কঠিন আযাব থেকে রক্ষা পাবেন। অভাবনীয় পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হবেন।

বর্তমানে আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে অপরাধ, সুদ-ঘুষ ও দুর্নীতির অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আমরা যদি আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগের দিকে থাকাই তাহলে দেখব, মানুষ গড়ার কারিগর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপরাধ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি সমাজকে কীভাবে উদ্ধার করেছিলেন। অন্ধকার সমাজকে আলোয় রূপান্তর করেছিলেন। তখন তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন যা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সে শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস ছিল আল-কুরআন ও আল-হাদীস। এ শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা. এর মত মানবেতিহাস খ্যাত শাসক ও মনীষী।

এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হয়েছিলেন, যারা অপরাধের পর বিবেকের কষাঘাতে ঠিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য নবীজির বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভুক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তাদের মাঝে। তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাতে-দিনে সুন্দরী-রূপবতী মহিলারা মূল্যবান সব অলঙ্কার পরে একাকি পথ চলেছে কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করেনি। কেউ তার দিকে চোখ তুলে দৃষ্টিপাতও করেনি। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর বিশ্বস্ত আমানতদার বনে গিয়েছিল।

আল-কুরআনের আইন এমন একদল সোনার মানুষ তৈরি করল যে, অর্ধেকটা পৃথিবীর বাদশাহী হাতের মুঠোয় পেয়েও দায়িত্বের ভার তাকে এমনভাবে তাড়া করে ফিরতো যে, আরামের ঘুম দূরে ঠেলে দিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়তো অভুক্ত মানুষের সন্ধানে। কোথাও কি অসহায় মানবতা জুলুমের শিকার হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করছে? কেউ কি তাঁর শাসন কাজে অসন্তুষ্ট? এ সমস্ত প্রশ্ন তাকে সদা অস্থির করে তুললো। দিবারাত্রি তাড়া করে ফিরতো ।

এ ধরনের তাকওয়া সম্পন্ন জনগোষ্ঠি নিয়ে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠবে, সেটিই হবে আল-কুরআনের সমাজ, ইসলামী সমাজ ও আল্লাহর পছন্দের সমাজ। এ সমাজের প্রতিটি লোক ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন। দুর্নীতির মূলোচ্ছেদে পৃথিবীর কোন জীবনব্যবস্থাই সম্পূর্ণরূপে সফল হতে পারেনি। যেমনটা পেরেছে ইসলাম।

এ ধরনের তাকওয়া ভিত্তিক রাষ্ট্রের উন্নয়নকল্পে আল্লাহ আসমান ও জমিনের দুয়ারসমূহ খুলে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি সেই সময় জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান ও জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, অতঃপর তাদের কর্মকা-ের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি। (সুরা আরাফ, আয়াত: ৯৬)

ইসলামি আইনে অপরাধী ও দুর্নীতিবাজের কোন ছাড় নেই : হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মাখজুম গোত্রের এক নারী চুরির ঘটনা কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে ? তারা বলল, একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উসামা বিন জায়েদ রা. এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা রা. নবীজির সঙ্গে কথা বলেন। নবীজি বললেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ ? অতঃপর নবীজি দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে, যে যখন তাদের মধ্যে কোন বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক যদি চুরি করত, তখন তার ওপর হদ জারি করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ এর কন্যা ফাতেমা চুরি করত তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪৭৫)।

এই হাদিস থেকে পরিস্কার ভাবে বুঝা যায় জাতি, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বকালে সব সমাজে ইসলামি আইন সমতার বিধান করে। এখানে জাতি, গোত্র, আর বর্ণের কোন বিভেদ থাকে না। আমাদের দেশে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো সাময়িকভাবে দুর্নীতির বিস্তার রোধ করেছে, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের চরিত্র পরিবর্তনে এসব পদক্ষেপের সাফল্য খুব কমই পাওয়া গেছে। একমাত্র ইসলামি আইনকাঠামোসহ ইসলামি শিক্ষাই একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির মনে প্রয়োজনীয় নৈতিক মনোবল তৈরি করতে পারে, যাতে সে দুর্নীতিতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান অনুভব করবে। একইভাবে অধিকাংশ সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ কাক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মূল কারণ আমরা সমস্যার মূলে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়েছি। যেটা একমাত্র ইসলাম ও ইসলামি আইনি কাঠামোর মাধ্যমেই করা যায়। ইসলাম বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ ও বহিরাবরণের দিক থেকে কোনো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে না, বরং সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে তার প্রকৃতি ও কারণ বোঝার চেষ্টা করে। একেবারে গোড়া থেকে সমস্যার মূলোৎপাটন করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে ইসলামি আইনের বিভিন্ন কাঠামোর সূচনা ও বিকাশ শুরু হয়। পরে বিভিন্ন খেলাফতের সময় তা পরিপক্বতা লাভ করে। তখন সমাজে অপরাধপ্রবণতা ছিল কম এবং মানুষ সুখ-শান্তিতে বসবাস করত। যে দেশে ইসলাম আইন থাকবে সে দেশে মানুষের মাঝে দুর্নীতি প্রবণতা একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তাই ইসলামি আইন ও বিচারব্যবস্খার ওপর গবেষণা ও অধ্যয়ন আরো বৃদ্ধি করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামি আইনের কার্যকারিতা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।

দুর্নীতিমুক্ত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং তাকওয়ার (আল্লাহভীতি) ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন। সকল পিতা-মাতার উচিত নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসাবে গড়ে তোলা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুশীলন করানো। সমাজপ্রতি এবং সচেতন নাগরিকদের উচিত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার মানদন্ড রক্ষা করা। রাজনৈতিক পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পদমর্যাদা ও দ্রব্যমূল্য সামনে রেখে সম্মানজনক জীবন-জীবিকার উপযোগী বেতনভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এভাবেই সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব। কারণ দুর্নীতির সব ব্যবস্থা উন্মুক্ত রেখে দুর্নীতি দমন অসম্ভব। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পন্থায় আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য আমাদের সেই কুরআন যা আজো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে আকড়ে ধরতে হবে। ইসলামি আইনকে আমাদের সকল কাজে মূলনীতি রূপে গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের সেই সোনালী যুগের ন্যায়-নীতি বর্তমানেও বাস্তবায়ন করা হলে সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি থাকবে না।